মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: শেষ অংশ

আফগান শাসন ও বারভূঁইয়া (১৫৩৮ খ্রি: - ১৫৭৬ খ্রিঃ)

১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হলে একে একে বিদেশি শক্তিসমূহ গ্রাস করতে থাকে বাংলাকে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছুকাল বাংলার রাজধানীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন' শেষ পর্যন্ত তাঁকে আফগান নেতা শের শাহের কাছে পরাজয় মানতে হয়। বাংলা ও বিহার সরাসরি চলে আসে আফগানদের হাতে। আফগানদের দুই শাখা-শূর আফগান ও কররাণী আফগানরা বেশ কিছুকাল বাংলা শাসন করে। শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবর আফগানদের হাত থেকে বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেন। রাজধানী দখল করলেও মুঘলরা বাংলার অভ্যন্তরে অনেক দিন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এ সময় বাংলায় অনেক বড় বড় স্বাধীন জমিদার ছিলেন। ‘বার ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত এ সমস্ত জমিদার মুঘলদের অধিকার মেনে নেননি। সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সুবাদারগণ ‘বার ভূঁইয়াদের’ দমন করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। ‘বার ভূঁইয়াদের’ দমন করা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে।

আফগান শাসন

মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুন হুসেনশাহী যুগের শেষদিক থেকেই চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে মুঘল অধিকারে নিয়ে আসতে। কিন' আফগানদের কারণে মুঘলদের এ উদ্দেশ্য প্রথম দিকে সফল হয়নি। আফগান নেতা শের খান শূরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সম্রাট হুমায়ুন। শের খানের পিতা হাসান খান শূর বিহারে অবসি'ত সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি জায়গিরদার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এ সময় বিহারের জায়গিরদার জালাল খান নাবালক বলে তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শের খান।

সমগ্র ভারতের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন ছিল শের খানের। তাই গোপনে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। এ লক্ষ্যে অল্প সময়ের মধ্যে শের খান শক্তিশালী চুনার দুর্গ ও বিহার অধিকার করেন। তিনি ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে দু’বার বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। এবার সতর্ক হন দিল্লির মুঘল সম্রাট হুমায়ুন। তিনি শের খানের পিছু ধাওয়া করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নেন। গৌড়ের চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন এর নামকরণ করেন ‘জান্নাতবাদ’। সম্রাট গৌড়ে ৬ মাস আমোদ ফূর্তিতে গা ভাসিয়ে দেন। এ সুযোগে নিজের শক্তি বাড়াতে থাকেন শের খান। দিল্লি থেকে খবর আসে হুমায়ুনের সৎভাই হিন্দাল সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্র করছেন। এ খবর পেয়ে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করেন। এ সুযোগ কাজে লাগান শের খান। তিনি ওঁত পেতে থাকেন বক্সারেরী নিকট চৌসা নাম স্থানে। গঙ্গা নদীর তীরে এ স্থানে হুমায়ুন পৌঁছালে শের খান তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপ্রস'ত হুমায়ুন পরাজিত হন (১৫৩৯ খ্রিঃ)।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের খান ‘শের শাহ’ উপাধি নেন। তিনি নিজেকে বিহারের স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। এবার বাংলার দিকে দৃষ্টি দেন তিনি। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনকর্তা আলী কুলিকে পরাজিত করে তিনি বাংলা দখল করেন। এ বছরই তিনি হুমায়ুনকে কনৌজের নিকট বিলগ্রামের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে

পরাজিত করে দিলি- সিংহাসন অধিকার করেন। এভাবে দীর্ঘদিন পর বাংলা আবার দিল্লির শাসনে চলে আসে। চট্টগ্রামরী ও সিলেট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ শের শাহের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। শের শাহ শূর বংশের বলে এ সময়ের বাংলার শাসন ছিল শূর আফগান বংশের শাসন।

শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ‘ইসলাম খান’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি আট বছর (১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিঃ) রাজত্ব করেন। কিন' ইসলাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরুজ খানের সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে সূর বংশের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়। শের খানের ভাগ্নে মুবারিজ খান ফিরুজ খানকে হত্যা করে ‘মুহম্মদ আদিল’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাবলী হতে এ সময় বাংলা বিচ্ছিন্ন ছিল না। তাই ইসলাম খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার আফগান শাসক মুহম্মদ খান সূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। উপাধি ধারণ করেন ‘মুহম্মদ শাহ শূর’। এ সময় হতে পরবর্তী কুড়ি বছর পর্যন্ত বাংলা স্বাধীন ছিল। মুহম্মদ শাহ সূর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ আদিল শাহ সূরের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। তিনি জৌনপুর জয় করে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন। কিন' চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।

মুহম্মদ শাহ সূর নিহত হলে দিল্লির বাদশাহ আদিল শাহ শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মুহম্মদী শাহের পুত্র খিজির খান তখন এলাহাবাদে অবস্থান করছিলেন। পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ’ উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন। কিছুদিন পর তিনি শাহবাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন।

এ সময় দিল্লির রাজনৈতিক পরিসি'তি যথেষ্ট ঘোলাটে হয়ে উঠে। শের শাহের বংশধরদের দুর্বলতার সুযোগে মুঘলী বাদশাহ হুয়ায়ূন স্বীয় রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। কিন' দিল্লিতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলায় তিনি মুঘল আধিপত্যী বিস্তার করার সুযোগ পেলেন না। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে শূর বংশীয়ী আফগান নেতৃবৃন্দকে একে একে দমন করার জন্য অগ্রসর হলেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রিঃ) আদিল শাহের সেনাপতি হিমু মুঘল সৈন্যদের নিকট পরাজিত ও নিহত হন। এতে আদিল শাহ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি বাংলার দিকে পলায়ন করলেন। পথিমধ্যে সুরজগড়ের নিকটবর্তী ফতেহপুরে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ কর্তৃক এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন (১৫৫৭ খ্রিঃ)।

বাংলা বিজয়ী আফগান সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হলে মুঘল সেনাপতি খান-ই-জামান তাঁর গতিরোধ করেন। কূটকুশলী বাহাদুর শাহ খান-ই-জামানের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তিনি বাংলার বাহিরে আর কোনো অভিযান প্রেরণ করেননি। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা জালালউদ্দীন শূর ‘দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দীন’ উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনিও তাঁর ভ্রাতার ন্যায় মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতেন। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁর একমাত্র পুত্র বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন' তাঁর নাম জানা যায়নি। মাত্র সাত মাস রাজত্ব করার পর তৃতীয় গিয়াসউদ্দীন নামে জনৈক আফগান দলনেতা তাঁকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। কিন' তিনিও বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। কররাণী বংশের রাজা তাজ খান কররাণী গিয়াসউদ্দীনকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

তাজ খান কররাণী ও সুলায়মান খান কররাণী শের শাহের সেনাপতি ছিলেন। কনৌজের যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শের শাহ তাদেরকে দক্ষিণ বিহারে জায়গীর প্রদান করেন। ইসলাম শাহের রাজত্বকালে তাজ খান কররাণী সেনাপতি ও কূটনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ইসলাম শাহের বালকপুত্র ও উত্তরাধিকারী ফিরুযের সময় তাজ খান উজির নিযুক্ত হন। ফিরুযকে হত্যা করে তাঁর মাতুল মুহম্মদ আদিল সূর সিংহাসনে বসেন। এ সময় তাজ খান কররাণী পালিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের সহায়তায় দক্ষিণ বিহারে প্রাধান্য স্থাপন করেন। ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাজ খান কররাণী নামমাত্র বাংলার সুলতান বাহাদুর শাহ শূরের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে পড়েন।

বাংলার সিংহাসনের প্রতিও তার দৃষ্টি ছিল। তিনি সুযোগের অন্বেষণে ছিলেন। অজ্ঞাতনামা গিয়াসউদ্দীন যখন শূর বংশের সিংহাসন দখল করেন তখন সুযোগ বুঝে তাজ খান ও তাঁর ভ্রাতারা গিয়াসউদ্দীনকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় দখল করেন। এভাবে তাজ খান কররাণী বাংলায় কররাণী বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

তাজ খান কররাণীর মৃত্যুর পর ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভাই সুলায়মান খান কররাণী বাংলার সুলতান হন। এ দক্ষ শাসক আফগান নেতাদের তাঁর দলভুক্ত করেন। এভাবে বাংলা ও বিহারের অধিকাংশ এলাকা তাঁর অধিভুক্ত হয়। উড়িষ্যাতেও তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলায়মান কররাণীর বিজ্ঞ উজির লোদী খানের পরামর্শে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম গৌড় হতে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবসি'ত তাণ্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৭২ খিস্টাব্দে সুলায়মান কররাণীর মৃত্যু হলে পুত্র বায়জিদ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই এ অত্যাচারী সুলতানকে হত্যা করেন আফগান সর্দাররা। এবার সিংহাসনে বসেন সুলায়মান কররাণীর দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কররাণী। তিনিই ছিলেন বাংলায় শেষ আফগান শাসক। দাউদ কররাণী খুব অদূরদর্শী শাসক ছিলেন। বিশাল রাজ্য ও ধন ঐশ্বর্য দেখে তিনি নিজেকে সম্রাট আকবরের সমকক্ষ ভাবতে থাকেন। এতদিন বাংলা ও বিহারের আফগান শাসকগণ প্রকাশ্যে মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন। কিন' দাউদ স্বাধীন সম্রাটের মত ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজ নামে খুৎবা পাঠ করেন ও মুদ্রা জারি করেন।

আফগানরা এমনিতেই মুঘলদের শত্রু ছিল। তার ওপর বাংলা-বিহার মুঘলদের অধিকারে না থাকায় সম্রাট আকবরের স্বস্তি ছিলনা। দাউদ কররাণীর আচরণ আকবরকে বাংলা আক্রমণের সুযোগ করে দিল। প্রথমে আকবর জৌনপুরের শাসনকর্তা মুনিম খানকে নির্দেশ দেন কররাণী রাজ্য আক্রমণ করতে। প্রথমদিকে সরাসরি আক্রমণ করেননি মুনিম খান। উজির লোদী খানের পরামর্শে মুনিম খানের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। দাউদ খান উজির লোদীর পরামর্শে মুনিম খানের সাথে ধনরত্ন দিয়ে আপোস করেন। কিন্তু অচিরেই এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। দাউদ কিছু ষড়যন্ত্রকারীর পরামর্শে ভুল বোঝেন উজির লোদীকে। দাউদের নির্দেশে হত্যা করা হয় তাঁকে। লোদীর বুদ্ধির গুণেই এতদিন মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল বাংলা ও বিহার। মুনিম খানের আর বাঁধা রইল না। মুনিম খান লোদীর মৃত্যুর পর ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার থেকে আফগানদের হটিয়ে দেন। আফগানরা ইতোমধ্যে নিজেদের ভেতর বিবাদ করে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ সুযোগে মুনিম খান বাংলার দিকে অগ্রসর হন। কররাণীদের বাংলার রাজধানী ছিল তাণ্ডায়। আফগানরা তান্ডা ছেড়ে পিছু হটে। আশ্রয় নেয় হুগলী জেলার সপ্তগ্রামে। রাজধানী অধিকার করে মুঘল সৈন্যরাও অগ্রসর হয় সপ্তগ্রাম-এ। দাউদ খান পালিয়ে যান উড়িষ্যায়। মুনিম খান তান্ডায় মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তান্ডায় পে- রোগ দেখা দিলে মুনিম খানসহ অনেক মুঘল সৈন্য এ রোগে মারা যান। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এগ অবস্থার সুযোগে দাউদ কররাণী পশ্চিম ও উত্তর বাংলা পুনরায় অধিকার করে নেন। অন্যদিকে ভাটি অঞ্চলের জমিদার ঈসা খান পূর্ব বাংলা থেকে মুঘল সৈন্যদের হটিয়ে দেন। মুঘল সৈন্যরা এবার বাংলা ছেড়ে আশ্রয় নেয় বিহারে।

মুনিম খানের মৃত্যু সংবাদ আগ্রায় পৌঁছালে সম্রাট আকবর বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠান খান জাহান হুসেন কুলী খানকে। তাঁর সহকারী নিযুক্ত হন রাজা টোডরমল। বাংলায় প্রবেশ পথে রাজমহলে মুঘল সৈন্যদের বাঁধা দেন দাউদ কররাণী। মুঘলদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের নিকট মুঘল ও আফগানদের মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ হয়। রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররাণীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। পরে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এভাবে বাংলায় কররাণী আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। অবশ্য ‘বার ভূঁইয়াদের’ বাঁধার মুখে মুঘল শাসন বেশি দূর বিস-ৃত হতে পারেনি।

বার ভূঁইয়াদের ইতিহাস

সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার উপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদাররা মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি। জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারীতে স্বাধীন ছিলেন। এদের শক্তিশালী সৈন্য ও নৌ-বহর ছিল। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ ‘বার ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। এ ‘বার’ বলতে বারজনের সংখ্যা বুঝায় না। ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বোঝাতেই ‘বার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলার ইতিহাসে বার ভূঁইয়াদের আবির্ভাব ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তীকাল হতে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলোচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাঁরাই ‘বার ভূঁইয়া’। এছাড়াও বঙ্গদেশে আরও অনেক ছোটখাট জমিদার ছিলেন। তাঁরাও মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ান। কিন' পরে এঁরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। বার ভূঁইয়াদের মধ্যে উলে- যোগ্য হলেন:

বার ভূইয়াদের নাম

এলাকার নাম

ঈসা খান, মূসা খান

ঢাকা জেলার অর্ধাংশ, প্রায় সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা এবং পাবনা, বগুড়া ও রংপুর জেলার কিছু অংশ

চাঁদ রায় ও কেদার রায় শ্রীপুর (বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ)
বাহাদুর গাজী ভাওয়াল
সোনা গাজী সরাইল (ত্রিপুরার উত্তর সীমায়)
ওসমান খান বোকাইনগর (সিলেট)
বীর হামির বিষ্ণুপুর (বাকুড়া)
লক্ষণ মাণিক্য ভুলুয়া (নোয়াখালী)
পরমানন্দ রায় চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল)
বিনোদ রায়, মধু রায় চান্দপ্রতাপ (মানিকগঞ্জ)
মুকুন্দরাম, সত্রজিৎ ভূষণা (ফরিদপুর)

রাজা কন্দর্পনারায়ণ, রামচন্দ্র

বরিশাল জেলার অংশ বিশেষ

প্রথম দিকে বার ভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান। হুসেন শাহী বংশের অবসান হলে ঈসা খানের পিতা সুলায়মান খান সোনারগাঁও অঞ্চলে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। খিজিরপুর দুর্গ ছিল তাঁর শক্তির প্রধান কেন্দ্র। সোনারগাঁও ও খিজিরপুরের নিকটবর্তী কাত্‌রাবু তাঁর রাজধানী ছিল। দাউদ কররাণীর পতনের পর তিনি সোনারগাঁও-এ রাজধানী স্থাপন করেন।

বার ভূঁইয়াদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর বিশেষ মনোযোগ দেন। এজন্য তিনি ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে শাহবাজ খান, ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাদিক খান, ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে উজির খান ও ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। তাঁরা ঈসা খাঁন ও অন্যান্য জমিদারের সাথে বহুবার যুদ্ধ করেন। কিন্তু বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। তিনি সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।

১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ঈশা খানের মৃত্যু হলে বার ভূঁইয়াদের নেতা হন তাঁর পুত্র মূসা খান। এদিকে ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহকে দ্বিতীয়বারের মত বাংলায় পাঠানো হয়। এবার মানসিংহ কিছুটা সফল হন। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মূসা খান এক নৌ-যুদ্ধে মানসিংহের হাতে পরাজিত হন। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার আগে সম্রাট আকবরের অসুস'তার খবর আসে। সম্রাটের ডাকে মানসিংহ আগ্রায় ফিরে যান।

সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সেলিন ‘জাহাঙ্গীর’ নাম ধারণ করে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণী করেন। তিনি মানসিংহকে আবার বাংলায় প্রেরণ করেন। এক বছর পর ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দীন কোকাকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করা হয়। কুতুবুদ্দীন শের আফকুনের হাতে প্রাণ হারান। তাঁর পরবর্তী সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলীখান এক বছর পর মারা যান। এর পর ইসলাম খান ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের সুবাদার নিযুক্ত হন।

বাংলার বার ভূঁইয়াদের দমন করে এদেশ মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের কৃতিত্বপূর্ণ কার্য। আর এ কৃতিত্বের দাবিদার সুবাদর ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি:)। শাসনভার গ্রহণ করেই তিনি বুঝতে পারেন যে, বার ভূঁইয়াদের নেতা মূসা খানকে দমন করতে পারলেই তাঁর পক্ষে অন্যান্য জমিদারদেরকে বশীভূত করা সহজসাধ্য হবে। সেজন্য তিনি রাজমহল হতে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ, মূসা খানের ঘাঁটি সোনারগাঁও ঢাকার অদূরে ছিল। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আসার পথে ইসলাম খান বেশ কজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেছিলেন।

বার ভূঁইয়াদের মোকাবেলা করার জন্য ইসলাম খান শক্তিশালী নৌ-বহর গড়ে তোলেন। মূসা খানের সাথে প্রথম সংঘর্ষ বাঁধে ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে করতোয়া নদীর পূর্বতীরে যাত্রাপুরে। এখানে মূসা খানের দুর্গ ছিল। যুদ্ধে মূসা খান ও অন্যান্য জমিদার শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন। ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রবেশ করেন। এ সময় থেকে ঢাকা হয় বাংলার রাজধানী। সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীর নগর’।

এরপর পুনরায় মূসা খানের নেতৃত্বে মুঘলদের বাঁধা দেবার জন্য জমিদারদের নৌ-বহর একত্রিত হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। ইসলাম খান এর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন স্থানে সৈন্যদল ও নৌ-বহর প্রেরণ করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খানের সঙ্গে জমিদারদের যুদ্ধ শুরু হয়। নদীর পূর্ব পাড়ে অবসি'ত মূসা খানের কদম রসুল দুর্গসহ অন্যান্য দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে। অবস্থার বিপর্যয়ে মূসা খান সোনারগাঁও চলে আসেন। রাজধানী নিরাপদ নয় মনে করে তিনি মেঘনা নদীতে অবসি'ত ইব্রাহিমপুর দ্বীপে আশ্রয় নেন। মুঘল সৈন্যরা সোনারগাঁও অধিকার করে নেন। এর ফলে জমিদারগণ বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে। কোন উপায় না দেখে মূসা খানও শেষ পর্যন্ত মুঘলদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। ইসলাম খান মূসা খানকে অন্যান্য জমিদারদের মতো তাঁকেও তাঁর জমিদারিতে মুঘলদের অধীনস' জায়গিরের দায়িত্ব দিলেন। এরপর মূসা খান সম্রাটের অনুগত জায়গিরদার হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। মূসা খানের আত্মসমর্পণে অন্যান্য জামিদারগণ নিরাশ হয়ে মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন। এভাবে বাংলার বার ভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে।

মুঘল শাসন (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিঃ)

সুবাদারি ও নবাবি- এ দুই পর্বে বাংলায় মুঘল শাসন অতিবাহিত হয়। বার ভূঁইয়াদের দমনের পর সমগ্র বাংলায় সুবাদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল প্রদেশগুলো ‘সুবা’ নামে পরিচিত ছিল। বাংলা ছিল মুঘলদের অন্যতম সুবা। সতের শতকের প্রথম দিক থেকে আঠার শতকের শুরু পর্যন্ত ছিল সুবাদারী শাসনের স্বর্ণযুগ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর দিল্লিরী দুর্বল উত্তরাধিকারীদের সময়ে মুঘল শাসন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে বাংলার সুবাদারগণ প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। মুঘল আমলের এই যুগ ‘নবাবী আমল’ নামে পরিচিত।

সুবেদারী ও নবাবী আমল

সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বার ভূঁইয়াদের দমন করে সমগ্র বাংলায় সুবাদারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর বেশ কজন সুবাদার বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তবে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার মীর জুমলা ক্ষমতা গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত কোন সুবাদারই তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেননি। এঁদের মধ্যে ইসলাম খান চিশতি (১৬১৭-১৬২৪ খ্রিঃ) এবং দিল্লির সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ (১৬১৭-১৬২৪খ্রিঃ) বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতপর খুব অল্প সময়ের জন্য সুবাদার নিযুক্ত হন দারার খান, মহব্বত খান, মুকাররম খান এবং ফিতাই খান।

সম্রাট শাহজাহান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বাংলার সুবাদার হিসেবে কাসিম খান জুয়িনীকে নিয়োগ করেন ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে। হুসেন শাহী যুগ হতেই বাংলায় পর্তুগীজরা বাণিজ্য করত। এ সময় পর্তুগীজ বণিকদের প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়। ক্রমে তা বাংলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কাসিম খান জুয়িনী শক্ত হাতে পর্তুগীজদের দমন করেন।

কাসিম খানের পর সুবাদার ইসলাম খান মাসহাদী (১৬৩৫-১৬৩৯ খ্রিঃ) চার বছর শাসন করেন। অতঃপর শাহজাহান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। সুজা কুড়ি বছর দায়িত্বে ছিলেন। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল সুজার শাসনকাল। বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর মধ্যে ইংরেজরা এ সময় সুবাদারের কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করছিল। এতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ইংরেজদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান অসুস' হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের প্রত্যেকেই সম্রাট হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করে। এ সময় আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই ভাইয়ের যুদ্ধে ১৬৫৯ খিস্টাব্দে শাহ সুজা পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে তিনি আরাকান গমন করেন। সেখানে পরে তিনি সপরিবারে নিহত হন।

আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে দমন করার জন্য বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত এসেছিলেন। তাই সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে (১৬৬০-১৬৬৩ খ্রিঃ) বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব দেন। অহমদের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য তেমন উলে- যোগ্য না হলেও কুচবিহার ও আসাম বিজয় মীর জুমলার সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।খ তাঁর সময়েই কুচবিহার সম্পূর্ণরূপে প্রথমবারের মতো মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। আসাম অভিযানের দ্বারা তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্ত আসাম পর্যন্ত বর্ধিত করেন।

মীর জুমলার মৃত্যুর পর প্রথমে দিলির খান ও পরে দাউদ খান অস্থায়ী সুবাদার হিসেবে বাংলা শাসন করেন। অতপর আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খানকে (১৬৬৪-১৬৮৮ খ্রিঃ) বাংলার সুবাদার নিয়োগ দেওয়া হয়।

মাঝখানে ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তাঁকে দিলি-ত ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ১৬ে৭৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার সুবাদার হন।

শায়েস্তা খান ছিলেন একজন সুদক্ষ সেনাপতি ও দূরদর্শী শাসক। তিনি মগদের উৎপাত হতে বাংলার জনগণের জানমাল রক্ষা করেন। তিনি সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম অধিকার করে আরাকানী জলদস্যুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করেন। সুবাদার শায়েস্তা খান কুচবিহার, কামরূপ, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে মুঘল শাসন সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করা হয়।

তাঁর ভয়ে আসামের রাজা মুঘলদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে সাহস পাননি। সুবাদারীর চিত্র : শায়েস্তা খানশেষ দিকে শায়েস্তা খানের সাথে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ বাঁধে। ইংরেজদের ক্ষমতা এত বৃদ্ধি পেতে থাকে যে তারা ক্রমে এদেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর শায়েস্তা খান বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। শায়েস্তা খানের পর একে একে খান-ই-জাহান বাহাদুর, ইব্রাহিম খান ও আজিমুদ্দিন বাংলার সুবাদার হন। তাঁদের সময় বাংলার ইতিহাস তেমন ঘটনাবহুল ছিলনা।

শায়েস্তা খান তাঁর শাসন আমলের বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলীর জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য সরাইখানা, রাস্তা ও সেতু নির্মিত হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ও কৃষি ক্ষেত্রে তিনি অভাবিত সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। জনকল্যাণকর শাসনকার্যের জন্য শুধু বাংলায় নহে, সমগ্র ভারতবর্ষেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সময়ে দ্রব্য মূল্য এত সস্তা ছিল যে, টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যেত।

শায়েস্তা খানের আমলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূলে ছিল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। এ আমলে কৃষি কাজের সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। শায়েস্তা খান ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদেশী বণিকদিগকে উৎসাহিত করতেন।

শায়েস্তা খানের শাসনকাল বাংলার স্থাপত্য শিল্পের জন্য সবিশেষ উলে- যোগ্য। বিচিত্র সৌধমালা, মনোরম সাজেখ সজ্জিত তৎকালীন ঢাকা নগরী স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের সাক্ষ্য বহন করে। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলায় মুঘলদের ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তাঁর আমলে নির্মাণ করা স্থাপত্য কার্যের মধ্যে ছোট কাটরা, লালবাগ কেল্লি, বিবি পরীর সমাধি-সৌধ, হোসেনী দালান, সফী খানের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার মসজিদ, চকা মসজিদ প্রভৃতি উলে- যোগ্য। মোটকথা, অন্য কোনো সুবাদার বা শাসনকর্তা ঢাকায় শায়েস্তা খানের ন্যায় নিজেরখ স্মৃতিকে এত বেশি জ্বলন্ত রেখে যেতে পারেননি। বস'ত, ঢাকা ছিল শায়েস্তা খানের নগরী।

দক্ষ সুবাদার হিসাবে এবার বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলী খান (১৭০০-১৭২৭ খ্রিঃ)। প্রথমে তাঁকে বাংলার দিউয়ান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দিউয়ানের কাজ ছিল সুবার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা। সম্রাট ফখরুখ শিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলী খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদ কুলী খান যখন বংলায় আগমনণ করেন তখন বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এ পরিসি'তির মুখে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সহিত বাংলায় মুঘল শাসন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। স্বীয় ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তিনি বাংলার ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তিত করেছিলেন।

সম্রাট আওঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দুর্বল মুঘল সম্রাটগণ দূরবর্তী সুবাগুলোর দিকে তেমন দৃষ্টি দিতে পারেননি। ফলে এসব অঞ্চলের সুবাদারগণ অনেকটা স্বাধীনভাবে নিজেদের অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। মুর্শিদ কুলী খানও অনেকটা স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি নামমাত্র সম্রাটের আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং বার্ষিক ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাতেন। মুর্শিদ কুলী খানের পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। এভাবে বাংলার সুবেদারি বংশগত হয়ে পড়ে। আর এরই পথ ধরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার স্বাধীন শাসন।

নবাব মুর্শিদ কুলী খানের সময় থেকেই বাংলা সুবা প্রায় স্বাধীন হয়ে পড়ে। এ সময় সুবাকে বলা হতো ‘নিজামত’ আর সুবাদারের বদলে পদবী হয় ‘নাজিম’। নাজিম পদটি হয়ে পড়ে বংশগত। সুবাদার বা নাজিমগণ বাংলার সিংহাসনে বসে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে শুধু একটি অনুমোদন নিয়ে নিতেন। তাই আঠারো শতকের বাংলায় মুঘল শাসনের ইতিহাস নিজামত বা নবাবি আমলরূপে পরিচিত। আর প্রায় স্বাধীন শাসকগণ পরিচিত হন ‘নবাব’ হিসেবে।

রাজস্ব সংস্কার মুর্শিদ কুলী খানের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি। তিনি ভূমি জরিপ করে রায়তদের সামর্থ্য অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন। রাজস্ব আদায়কে নিশ্চিত ও নিয়মিত করার জন্য তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কর্মচারীদের সাহায্যে ভূমির প্রকৃত উৎপাদিকা শক্তি ও বাণিজ্য করের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতেন। এ পদ্ধতিতে মধ্যস' ব্যক্তিদের দ্বারা প্রজাদের হয়রানির কোনো সুযোগ ছিল না।

মুর্শিদ কুলী খান দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ইংরেজ, ফরাসী ও পারসিক ব্যবসায়ীদেরকে তিনি উৎসাহ প্রদান করতেন। ব্যবসায়ীরা যাতে নির্দিষ্ট প্রচলিত কর প্রদান করে এবং তাদের প্রতি যাতে কোনো অবিচার করা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য সংশি-ষ্ট কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য সমপ্রসারিত হয়েছিল। কলকাতা, চুঁচুড়া ও চন্দননগর বিভিন্ন বিদেশী বণিকদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে।

মুর্শিদ কুলী খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। তাই তাঁর কন্যা জিনাত-উন-নিসার স্বামী সুজাউদ্দিন খানকে (১৭২৭- ১৭৩৯ খ্রিঃ) সম্রাট ফররুখ শিয়ার বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। সুজাউদ্দিন একজন স্বাধীন নবাবের মর্যাদা নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- তিন প্রদেশেরই নবাব হয়েছিলেন তিনি। তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বিশ্বাসভাজনদের উচ্চপদ দান করেন। জমিদারদের সাথেও একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু সুজাউদ্দিনের শেষ জীবন সুখে কাটেনি। প্রাসাদের অনেক কর্মকর্তা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। কিন্তু দক্ষ হাতে তিনি সংকট মোকাবিলা করেন। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হন। তাঁর অযোগ্যতার কারণে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সুযোগে বিহারের নায়েব-ই-নাজিম আলীবর্দী খান সরফরাজকে আক্রমণ করেন। সরফরাজ পরাজিত ও নিহত হন। মুঘল সম্রাটের অনুমোদনে নয়, বাহুবলে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন আলীবর্দী খান। আলীবর্দীর শাসনকালে (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রি:) বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

অনেকদিন থেকেই বর্গী নামে পরিচিত মারাঠি দস্যুরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। আলীবর্দী খান ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছর প্রতিরোধ করে বর্গীদের দেশ ছাড়া করতে সক্ষম হন। তাঁর শাসনকালে আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করলে তিনি শক্ত হাতে তা দমন করেন। আলীবর্দীর সময়ে ইংরেজসহ অনেক ইউরোপীয় বণিকের বাণিজ্যিক তৎপরতা বাংলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। একই সাথে এরা সামরিক শক্তিও সঞ্চয় করতে থাকে। আলীবর্দী খান শক্ত হাতে বণিকদের তৎপরতা রোধ করেন।

আলীবর্দী খান তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আলীবর্দীর প্রথম কন্যা ঘষেটি বেগমের ইচ্ছে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ভগ্নির পুত্র শওকত জঙ্গ নবাব হবেন। ফলে তিনি সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। কয়েকজন অভিজাতের সমর্থন লাভ করেন ঘষেটি বেগম। এদের মধ্যে রায় দুর্লভ,

জগৎশেঠ, মীরজাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লি প্রমুখের নাম করা যায়। প্রাসাদের ভেতর এ ষড়যন্ত্রকে কাজে লাগায় বাংলায়ভ বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুচতুর ইংরেজ বণিকরা। ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে তারা হাত মেলায়। অবশেষে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ বাধে নবাবের। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। অসহায়ভাবে পরাজয় ঘটে সিরাজউদ্দৌলার। এভাবেই পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। আর একই সাথে বাংলার মধ্যযুগেরও অবসান ঘটে।

====================================================
>>বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব
<<মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: দ্বিতীয় অংশ
====================================================

No comments:

Post a Comment