বাংলায় স্বাধীন সুলতানী শাসনের ইতিহাস
দিল্লির সুলতানগণ ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খিস্টাব্দ পর্যন- দুইশত বছর বাংলাকে তাঁদের অধিকারে রাখতে পারেননি। প্রথমদিকে দিল্লির সুলতানের সৈন্যবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে বাংলাকে নিজের অধিকারে আনার জন্য। অবশেষে সফল হতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এ সময়ে বাইরের অন্য কোনো আক্রমণেরও তেমন সম্ভাবনা ছিলনা। তাই বাংলার সুলতানগণ স্বাধীনভাবে এবং নিশ্চিনে- এদেশ শাসন করতে পেরেছেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের হাতে বাংলা প্রথম সি'তিশীলতা লাভ করে।
স্বাধীন সুলতানী আমল (১৩৩৮ খ্রিঃ - ১৫৩৮ খ্রিঃ)
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যু হয়। বাহরাম খানের বর্মরক্ষক ছিলেন ‘ফখরা’ নামের একজন রাজকর্মচারী। প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন। এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের। দিল্লির মুহম্মদ-বিন-তুঘলকেরী এ সময় সুদূর বাঙলার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ ছিলনা। তাই সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীন অঞ্চলের সীমা বিসতৃত হতে থাকে। পরবর্তী দুইশত বছর এ স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।
সোনারগাঁওয়ের বাইরে লখনৌতির শাসনকেন্দ্রে তখন দিল্লির শাসনকর্তাগণ শাসন করতেন। তাঁরা ফখরুদ্দিনেরী স্বাধীনতা ঘোষণাকে সুনজরে দেখেননি। তাই লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন মিলিতভাবে সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেননি। কদর খান ফখরুদ্দিনের সৈন্যদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
একজন স্বাধীন সুলতান হিসাবে ফখরুদ্দিন নিজ নামে মুদ্রা জারি করেছিলেন। তাঁর মুদ্রায় খোদিত তারিখ দেখে ধারণা করা যায়, তিনি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন- সোনারগাঁও রাজত্ব করেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাঁর রাজসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিছুটা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন। চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন- একটি রাজপথ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও টাকশাল থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ নামাঙ্কিত মুদ্রা জারি করা হয়। গাজী শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রায় ১৩৫২ খিস্টাব্দ পর্যন- তারিখ পাওয়া যায়। সুতরাং বোঝা যায়, ফখরুদ্দিন পুত্র গাজী শাহ পিতার মৃত্যুর পর সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন- তিন বছর রাজত্ব করেন।
ইলিয়াস শাহী বংশ
সোনারগাঁওয়ে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ যখন স্বাধীন সুলতান তখন লখনৌতির সিংহাসন দখন করেছিলেন সেখানকার সেনাপতি আলী মুবারক। সিংহাসনে বসে তিনি ‘আলাউদ্দিন আলী শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। লখনৌতিতে তিনিও স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। পরে রাজধানী স্থানান-রিত করেন পান্ডুয়ায় (ফিরোজাবাদ)। আলী শাহ ক্ষমতায় ছিলেন ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন-। তাঁর দুধভাই ছিলেন হাজী ইলিয়াস। তিনি আলী শাহকে পরাজিত ও নিহত করে ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ নাম নিয়ে বাংলায় একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজবংশের নাম ইলিয়াস শাহী বংশ। এরপর ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ অনেক দিন বাংলা শাসন করেন। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য হিন্দু রাজত্বের উত্থান ঘটেছিল।
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজাবাদের সিংহাসন অধিকারের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলার অধিপতি হন। সোনারগাঁও ও সাতগাঁও তখনও তাঁর শাসনের বাইরে ছিল। ইলিয়াস শাহের স্বপ্ন ছিল সমগ্র বাংলার অধিপতি হওয়া। তিনি প্রথম দৃষ্টি দেন পশ্চিম বাংলার দিকে। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সাতগাঁও তাঁর অধিকারে আসে। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপাল আক্রমণ করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করা হয়। এ সময় তিনি ত্রিহুত বা উত্তর বিহারের কিছু অংশ জয় করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন। উড়িষ্যাও তাঁর অধিকারে আসে। তবে ইলিয়াস শাহের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল পূর্ব বাংলা অধিকার।
ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও-এ ইলিয়াস শাহের হাতে পরাজিত হন। সোনারগাঁও দখলের মাধ্যমে সমগ্র বাংলার অধিকার সম্পন্ন হয়। তাই বলা হয়, ১৩৩৮ খিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতার সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে। বাংলার বাইরেও বিহারের কিছু অংশ- চম্পারণ, গোরক্ষপুর এবং কাশী ইলিয়াস শাহ জয় করেছিলেন। কামরূপের কিছু অংশও তিনি জয় করেন। মোটকথা, তাঁর রাজসীমা আসাম হতে বারানসি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ইলিয়াস শাহ দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করায় সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।
প্রথম দিকে দিল্লির সুলতান বাংলার এ স্বাধীনতা মেনে নেননি। সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর চেষ্টা ছিল বাংলাকে দিল্লির অধিকারে নিয়ে আসা। কিন' তিনি সফল হননি। ইলিয়াস শাহ দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে বর্ষা এলে জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ফিরোজ শাহ সন্ধির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে ইলিয়াস শাহের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিল্লি ফিরে যান।
শাসক হিসেবে ইলিয়াস শাহ ছিলেন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয়। তাঁর শাসনামলে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। হাজিপুর নামক একটি শহর তিনি নির্মাণ করেছিলেন। ফিরুজাবাদের বিরাট হাম্বামখানা তিনিই নির্মাণ করেন। এ আমলে স্থাপত্য শিল্প ও সংস্কৃতি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি ফকির-দরবেশদের খুব শ্রদ্ধা করতেন।
ইলিয়াস শাহ লখনৌতির শাসক হিসেবে বঙ্গ অধিকার করলেও তিনি দুই ভূখণ্ডকে একত্রিত করে বৃহত্তর বাংলার সৃষ্টি করেছিলেন। এ সময় হতেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসী ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত হয়। ইলিয়াস শাহ ‘শাহ-ই বাঙ্গালা’ ও ‘শাহ-ই-বাঙালি’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯৩ খ্রিঃ) বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার মতো তিনিও দক্ষ এবং শক্তিশালী শাসক ছিলেন। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৮ থেকে ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দী পর্যন্ত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও ফিরোজ শাহ তুঘলককে ব্যর্থ হতে হয়। পিতার মতো সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধির মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জাফর খানকে সোনারগাঁওয়ের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু জাফর খান এ পদ গ্রহণে রাজি হলেন না। ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে তিনিও দিল্লিতে ফিরে গেলেন। সোনারগাঁও এবং লখনৌতিতে আবার আগের মতোই সিকান্দার শাহের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রইল। ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিকান্দার শাহ সেভাবেই একে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করতে সক্ষম হন।
সুলতান সিকান্দার শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন ‘আজম শাহ’ (১৩৯৩-১৪১১ খ্রি:) উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহ যুদ্ধ বিগ্রহ ও স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের কৃতিত্ব ছিল অন্যত্র। তিনি তাঁর প্রজারঞ্জক ব্যক্তিত্বের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি তাঁর রাজত্বকালে আসামে বিফল অভিযান প্রেরণ করেন। জৌনপুরের রাজা খান জাহানের সহিত তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। চীনা সম্রাট ইয়াংলো তাঁর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। তিনিও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে চীনা সম্রাটের নিকট মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করেন। মোটকথা, আযম শাহ কোন যুদ্ধে না জড়ালেও পিতা এবং পিতামহের গড়া বিশাল রাজত্বকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন। রিয়াজ-উস-সালাতীন গ্রনে' তাঁর ন্যায় বিচারের এক অতি উজ্জ্বল কাহিনী বর্ণিত আছে।
সুপণ্ডিত হিসেবে সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। কবি-সাহিত্যিকগণকে তিনি সমাদর ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি কাব্য রসিক ছিলেন এবং নিজেও ফার্সী ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। পারস্যের প্রখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ হতো।
মুসলমান শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ বঙ্গের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তাঁর রাজত্বাকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর ‘ইউছুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। আযম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সুফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন। এ স্থান হতেই তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করে বেড়াতেন। ফলে পান্ডুয়া ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। ধর্মনিষ্ঠ সুলতানের নিকট হতে তিনি সর্বপ্রকার সাহায্য লাভ করেছিলেন। সুলতান মক্কা ও মদিনাতেও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ ছিলেন বঙ্গের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম এবং ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান। তাঁর মৃত্যুর পর হতেই এ বংশের পতন শুরু হয়।
রাজা গণেশ ও হাবসী শাসন
সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, বাংলার ইতিহাসের দুইশত বছর (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রিঃ) মুসলমান সুলতানদের স্বাধীন রাজত্বের যুগ। তথাপি এ দুইশত বছরের মাঝামাঝি অল্প সময়ের জন্য কিছুটা বিরতি ছিল। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফুদ্দিন হামজা শাহ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু এ সময় অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতা দখল নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তিনি এক বছর শাসন করার পর ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিনের হাতে নিহত হন। শিহাবউদ্দিন সুলতান হয়ে নিজের নাম নেন ‘শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ শাহ’। কিন' দুই বছরের মাথায় ১৪১৪-১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনিও ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন। এ সুযোগে হিন্দু অভিজাত রাজা গণেশ বাংলার ক্ষমতা দখল করেন।
বাংলার সুলতানরা অনেক উচ্চপদেই হিন্দুদের নিয়োগ করতেন। আজম শাহের একজন উচ্চপদস' অমাত্য ছিলেন রাজা গণেশ। জানা যায়, গণেশ প্রথমে দিনাজপুরের ভাতুলিয়া অঞ্চলের একজন রাজা ছিলেন। তিনি সুলতানের দরবারে চাকরি নেন। চাকরি নিয়েই তিনি গোপনে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল মুসলমানদের হটিয়ে পুনরায় হিন্দু শক্তির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যেই তিনি ইলিয়াস শাহীর বংশ উচ্ছেদ করে নিজে ক্ষমতায় বসেন। গণেশ অনেক সুফী সাধককে হত্যা করেন। মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য দরবেশদের নেতা নূর কুতুব-উল-আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির নিকট আবেদন জানান। ইব্রাহিম শর্কি সসৈন্যে বাংলায় উপসি'ত হলে গণেশ ভয় পেয়ে যান। অবশেষে তিনি আপোস করেন দরবেশ নূর কুতুব-উল-আলমের সাথে। শর্ত অনুযায়ী গণেশ তাঁর ছেলে যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং ছেলের হাতে বাংলার সিংহাসন ছেড়ে দেন। মুসলমান হওয়ার পর যদুর নাম হয় জালালউদ্দিন মাহমুদ। সুলতান ইব্রাহিম শর্কি জামালউদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে ফিরে যান নিজ দেশ জৌনপুরে।
গণেশ দু’বার সিংহাসনে বসেছিলেন। প্রথমবার কয়েক মাস মাত্র ক্ষমতায় ছিলেন। ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি ইব্রাহিম শর্কি জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। ইব্রাহিম শর্কি ফিরে গেলে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন গণেশ। তখন জালালউদ্দিনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। অনেক আচার-অনুষ্ঠান করিয়ে ছেলেকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনেন। গণেশ ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। রাজা গণেশের মৃত্যুর পর হিন্দু আমাত্যগণ গণেশের পুত্র মহেন্দ্রদেবকে বঙ্গে সিংহাসনে বসান। কিন' অতি অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে জালালউদ্দিন দ্বিতীয়বার বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ পর্যায়ে তিনি একটানা ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এ সুযোগ্য শাসকের সময় বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায়। প্রায় সমগ্র বাংলা এবং আরাকান ব্যতীত ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ অন্তত সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজ্যের বিভিন্ন টাকশাল হতে তাঁর নামে মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। পান্ডুয়া হতে তিনি গৌড়ে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে আহমদ শাহ আমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্রে সাদি খান ও নাসির খান নামক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন। এভাবে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের প্রায় ত্রিশ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটে।
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন
শামসুদ্দিন আহমদ শাহের মৃত্যুর পর তার হত্যাকারী ক্রীতদাস নাসির খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। কিন' আহমদ শাহকে হত্যা করার ব্যাপারে যে সকল অভিজাতবর্গ নাসির খানকে ইন্ধন দেন তারা নাসির খানের সিংহাসনে আরোহণকে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারলেন না। সম্ভবত ক্রীতদাসের আধিপত্যকে তারা অপমানজনক মনে করেছিলেন। তাই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাসির খানকে হত্যা করেন।
নাসির খান নিহত হওয়ার পর গৌড়ের সিংহাসন কিছু সময়ের জন্য শূন্য অবস্থায় পড়ে রইল। আহমদ শাহের কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। অতপর অভিজাতবর্গ মাহমুদ নামে ইলিয়াস শাহের এক বংশধরকে ১৪৫২ খিস্টাব্দে গৌড়ের সিংহাসনে বসান। ইতিহাসে তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ নামে পরিচিত। ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ এভাবে পুনরায় স্বাধীন রাজত্ব শুরু করেন। তাই এ যুগকে বলা হয় ‘পরবর্তী ইলিয়াস শাহী যুগ’। নাসিরউদ্দিন একজন দক্ষ সেনাপতি ও ন্যায়পরায়ন শাসক ছিলেন। যশোর ও খুলনা অঞ্চল নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে মুসলমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও বিহারের কতকাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি নিজ নামে মুদ্রাও জারি করেছিলেন।
১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার রাজত্বকাল থেকেই বরবক শাহ শাসক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা। তাঁর রাজত্বকালে বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায়। বরবক শাহের সহিত কামরূপ রাজ্যের সংর্ঘষের কথা জানা যায়। কিন্তু ফলাফল কি হয়েছিল তা সঠিক বলা যায় না। গঙ্গা নদীর উত্তরাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ভাগলপুর তাঁর শাসনকালে মুসলমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। কিন্তু মুঙ্গেরের পশ্চিমে অবসি'ত জেলাগুলো জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শার্কীর অধীনে ছিল। তাঁর সময়ে এ অঞ্চল জয় করা হয় বলে মনে হয়। চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নিয়ে গোলযোগ ছিল। বরবক শাহের রাজত্বকালের প্রথম দিকে ইহা আরাকান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। কিন' শেষ দিকে বরবক শাহ ইহা পুনরুদ্ধার করেন। যশোহর ও খুলনা তাঁর অধিকারে ছিল। তিনি দক্ষিণ দিকেও তাঁর রাজ্য বিস-ৃত করেছিলেন।
বরবক শাহই প্রথম অসংখ্য আবিসিনীয় ক্রীতদাস (হাবসী ক্রীতদাস) সংগ্রহ করে সেনাবাহিনী ও রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। নিয়োগকৃত এ হাবসী ক্রীতাদাসের সংখ্যা ছিল আট হাজার। তিনি সম্ভবত রাজ্যে একটি নিজস্ব দল গঠনের উদ্দেশ্যে এ সকল হাবসীদের নিয়ে বাহিনী গঠন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যের জন্য বিপদ ডেকে নিয়ে আসে।
সুলতান রুকনউদ্দীন বরবক শাহ একজন মহাপন্ডিত ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন শিলালিপিতে নিজ নামে এবং বিভিন্ন রাজকীয় খউপাধির সঙ্গে ‘আল-ফাজিল’ ও ‘আল-কামিল’⎯ এ দুটি উপাধির উলে- দেখতে পাওয়া যায়। এ হতে প্রমাণিত হয় যে, বরবক শাহ শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি শুধু পণ্ডিতই ছিলেন না, তিনি বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মেরই বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্র ছিলেন গীতগোবিন্দটীকা, কুমারসম্ভবটীকা, রঘুবংশটীকা প্রভৃতি গ্রনে'র লেখক। ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ নামক বিখ্যাত বাংলা কাব্যের রচয়িতা মালাধর বসু এ সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। বাংলা রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাস বরবক শাহের অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। বাসুদেবও সম্ভবত বরবক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এ সময়ের মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে ইব্রাহিম কাইয়ুম ফারুকী, আমীর জয়েনউদ্দীন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী ও মনসুর শিরাজীর নাম বিশেষভাবে উলে- যোগ্য। বরবক শাহ বিভিন্নভাবে কবি ও সাহিত্যিকদের সাহায্যখ করেছিলেন। তিনি যে একজন উদার ও অসামপ্রদায়িক মনের নরপতি ছিলেন তা হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা ও বহু হিন্দুকে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ হতে বুঝা যায়। এ দিক দিয়ে বরবক শাহের ন্যায় উদার মনোভাবাপন্ন শাসক শুধু বাংলার ইতিহাসে নহে, ভারতবর্ষের ইতিহাসেও দুর্লভ।
বরবক শাহ একজন প্রকৃত সৌন্দর্যরসিক ছিলেন। গৌড়ের ‘দাখিল দরওয়াজা’ নামে পরিচিত বিরাট ও সুন্দর তোরণটি বরবক শাহ্ই নির্মাণ করেছিলেন। এ আমলে চট্টগ্রামে এবং পটুয়াখালী জেলার মীর্জাগঞ্জে দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এ সমস্ত কার্যাবলী বিবেচনা করলে বঙ্গের সুলতানদের মধ্যে বরবক শাহ্কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলা যায়।
১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরবক শাহ পরলোক গমন করেন। পরে তাঁর পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ (১৪৭৪- ১৪৮১ খ্রিঃ) বাংলার সুলতান হন। পিতা ও পিতামহের গড়া বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর সময় অক্ষুণ্ন ছিল। তাঁর রাজ্য পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং পূর্বে সিলেট পর্যন্ত বিস-ৃত ছিল।
ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে বসেন। কিন' তিনি অসুস' হয়ে পড়লে তাঁকে অপসারণ করা হয়। বরবক শাহের ছোট ভাই হুসাইন ‘জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রিঃ)। তিনি নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন। কিন্তু এ সময় রাজদরবারে দুর্যোগ দেখা দেয়। হাবসী ক্রীতদাসরা এ সময় খুব ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। এদের প্রতাপ কমানোর জন্য জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ চেষ্টা করেন। এতে সমস্ত হাবসী ক্রীতদাস একজোট হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সুলতান শাহজাদা ছিলেন প্রাসাদ রক্ষীদলের প্রধান। ক্রীতদাসগণ প্রলোভন দ্বারা সুলতান শাহজাদা ও তার অধীনস' পাইকদের নিজ দলভুক্ত করে। শাহজাদা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে ফতেহ শাহ্কে হত্যা করে। ফতেহ শাহ নিহত হলে বাংলার সিংহাসনে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলায় হাবশিদের রাজত্বের সূচনা হয়।
হাবসী শাসন
বাংলার হাবসী শাসন মাত্র ছয় বছর (১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রিঃ) স্থায়ী ছিল। এ সময় এদেশের ইতিহাস ছিল অন্যায়, অবিচার, বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র আর হতাশায় পরিপূর্ণ। এ সময়ে চারজন হাবসী সুলতানের মধ্যে তিনজন হাবসী সুলতানকেই হত্যা করা হয়।
হাবসী নেতা সুলতান শাহজাদা ‘বরবক শাহ’ উপাধি নিয়ে প্রথম বাংলার ক্ষমতায় বসেন। কিন' কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হাবসী সেনাপতি মালিক আন্দিলের হাতে নিহত হন। মালিক আন্দিল ‘সাইফুদ্দিন ফিরুজ শাহ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। একমাত্র তাঁর তিন বছরের রাজত্বকালের (১৪৮৭-১৪৯০ খ্রিঃ) ইতিহাসই কিছুটা গৌরবময় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় নাসিরউদ্দিন শাহমুদ শাহ। কিন্তু কিছুকাল (১৪৯০-১৪৯১ খ্রিঃ) রাজত্ব করার পরই তিনি নিহত হন। এক হাবসী সর্দার তাঁকে হত্যা করে ‘শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ’ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন (১৪৯১-১৪৯৩ খ্রি:)। অত্যাচারী ও হত্যাকারী হিসেবে তার কুখ্যাতি ছিল। ফলে গৌড়ের সম্ভ্রান্ত লোকেরা মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেন মুজাফফর শাহের উজির সৈয়দ হোসেন। অবশেষে মুজাফফর শাহ নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় হাবশি শাসনের অবসান ঘটে।
হোসেন শাহী বংশ
হাবসী শাসন উচ্ছেদ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন সৈয়দ হোসেন। সুলতান হয়ে তিনি ‘আলাউদ্দিন হুসেন শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবেই বাংলায় ‘হুসেন শাহী বংশ’ নামে এক নতুন বংশের শাসনপর্ব শুরু হয়। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে হুসেনশাহী আমল (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রি:) ছিল সবচেয়ে গৌরবময় যুগ।
সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন হুসেন শাহী যুগের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি আরব দেশীয় সৈয়দ বংশের লোক ছিলেন। পিতা সৈয়দ আশরাফ-আল-হুসাইনী ও ভাই ইউসুফের সাথে তিনি মক্কা হতে বাংলায় আসেন এবং রাঢ়ের চাঁদপাড়া গ্রামে প্রথমে বসবাস শুরু করেন। হুসেন শাহ পরে রাজধানী গৌড়ে যান এবং মুজাফফর শাহের অধীনে চাকরি লাভ করেন। পরে তিনি উজির হন। এভাবেই তিনি বাংলার ক্ষমতায় আসেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব হতে সাম্রাজ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল। রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। হাবসী গোষ্ঠীর দুঃশাসনের ফলে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিটি সুলতানের হত্যার পেছনে তারা প্রধান ভূমিকা পালন করত। সিংহাসন লাভের পর হুসেন শাহ হাবসীদের এরূপ কার্যকলাপ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। কিন' তারা তাঁর আদেশ অমান্য করলে তিনি তাদের হত্যার আদেশ দেন। হুসেন শাহের এ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে প্রায় বার হাজার হাবসী প্রাণ হারায়। বাকি হাবসীরা রাজ্য হতে বিতাড়িত হলো।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল দেহরক্ষী পাইক বাহিনীর ক্ষমতার বিনাশ। এ পাইক বাহিনী রাজপ্রাসাদের সকল ষড়যন্ত্রের মূলে কাজ করত। হুসেন শাহ পাইকদের দল ভেঙ্গে দেন। তাদের জায়গায় সম্ভ্রান্ত হিন্দু ও মুসলমানদের নিয়ে একটি নতুন রক্ষীদল গঠন করেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ রাজ্যের কল্যাণের লক্ষে বঙ্গের রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে হাবসীদের প্রভাবমুক্ত করতে যেমন সচেষ্ট ছিলেন, তেমিন রাজধানী পরিবর্তন করে শাসন ব্যবস্থা দৃঢ় করেন। গৌড় রাজ্যের নিকটবর্তী এক জায়গায় তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। বঙ্গের সুলতানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই পান্ডুয়া বা গৌড় ব্যতীত অন্যত্র রাজধানী স্থাপন করেন। হাবসী শাসনকালে গোলযোগ
সৃষ্টিকারী আমীর-ওমরাহদের কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়। নীচ বংশজাত অত্যাচারী সকল কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়। তার পরিবর্তে তিনি শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ পদে সৈয়দ, মোঙ্গল, আফগান, হিন্দুদেরকে নিযুক্ত করেন। এ সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময় বাংলার রাজ্যসীমা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। তিনি কামরূপ ও কামতা জয় করেন। ঊড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশও তাঁর করায়ত্ত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ বিহারের কিছু অংশও তাঁর অধিকারে আসে।
তিনি আরাকানীদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করেন। এ সময়ে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদী বাংলা আক্রমণ করলে তিনি তা প্রতিহত করেন। একমাত্র আসাম অভিযানে তিনি সফল হতে পারেননি। তাঁর বিশাল রাজ্যে সব রকম নিরাপত্তা বিধানে হুসেন শাহ সফল হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ) রাজত্ব করেন। এ সুদীর্ঘ সময় সাফল্যের সাথে রাজ্য পরিচালনা করে এ মহান সুলতান ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। আলাউদ্দীন হুসেন শাহ্ সুশাসক ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং জনকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি যথেষ্ট উদ্যম, নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। রাজার জন্য রাজ্য জয়ই শেষ কথা নয়⎯ যুগোপযোগী ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থাও যে অপরিহার্য, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। শাসনকার্য পরিচালনায় ও প্রজাপালনের ক্ষেত্রে তিনি জাতি ও ধর্মের কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করেননি। হিন্দু ও মুসলমান-উভয় সমপ্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতি স্থাপনের দ্বারা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও কল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা তাঁর লক্ষ্য ছিল। এজন্য একজন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন হিন্দুকে যোগ্যতা অনুসারে শাসনকার্যে নিয়োগ করেছিলেন। হিন্দুদিগকে উৎসাহিত করার জন্য তিনি তাদেরকে বিভিন্ন উপাধিও প্রদান করতেন। হিন্দুদের প্রতি হুসাইন শাহের এ উদারতা সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য নির্বাহের চিত্র : শ্রীচৈতন্যক্ষেত্রে বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছিল এবং বাঙালিদের নিজস্ব ঐতিহ্য সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল। ইহা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও পরিচয় বহন করে। হুসেন শাহের এ ধর্মীয় উদারতা তাঁর উত্তরাধিকারীদেরও উৎসাহিত করেছিল। তাঁর শান্তিপূর্ণ রাজত্বকালে প্রজারা সুখে-শান্তিতে বাস করত।
হুসেন শাহের হিন্দু-মুসলামন সমপ্রীতি স্থাপনের প্রচেষ্টা তৎকালীন সমাজ-জীবনকেও প্রভাবিত করেছিল। তাঁর শাসনকালেই আবির্ভাব ঘটে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যের। হুসেন শাহ তাঁর প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন এবং তাঁকে ধর্ম প্রচারে সব রকমের সহায়তা করার জন্য কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দেন। সত্যপীরের আরাধনা হুসেন শাহের শাসনকালের আর একটি উলে- যোগ্য ঘটনা। সত্যপীরের আরাধনা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেখ একটি উজ্জ্বল প্রচেষ্টা।
বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশ হুসেন শাহের শাসনকালকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছে। হুসেন শাহ যোগ্য কবি ও সাহিত্যিকগণকে উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কার প্রদান করতেন। এ যুগের প্রখ্যাত কবি ও লেখকদের মধ্যে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, মালাধর বসু, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস, পরাগল খান ও যশোরাজ খান উলে- যোগ্য ছিলেন। হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা অসংখ্যখ গ্রন' রচনা করেন। তাঁদের নিরলস সাহিত্য-কীর্তি বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এ সময়ে মালাধর বসু ‘শ্রীমদ্ভাগবৎ’ ও ‘পুরাণ’ এবং পরমেশ্বর ‘মহাভারত’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। আলাউদ্দীন হুসেন শাহ আরবী ও ফার্সী ভাষারও উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
হুসেন শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। নিজ ধর্ম ও সুফী সাধকদের প্রতি তাঁর অপরিসীম নিষ্ঠা ও ভক্তি ছিল। তাঁর রাজত্বকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এ সমস্ত মসজিদের মধ্যে গৌড়ের ‘ছোট সোনা মসজিদ’ সবচেয়ে উলে- যোগ্য। রাজ্যে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশের জন্য অনেক খানকাহ্ ও মাদ্রাসা নির্মিতখ
হয়েছিল। পান্ডুয়ার মুসলমান সাধক কুতুব-উল-আলমের সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হুসেন শাহ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। হুসেন শাহ্ গৌড়ে একটি দুর্গ ও তোরণ, মালদহে একটি বিদ্যালয় ও একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। এ সকল মসজিদ, মাদ্রাসা, দুর্গ, তোরণ হুসেন শাহের স্থাপত্য প্রীতির পরিচয় বহন করে। তাঁর ২৬ বছরের শাসনকালে বঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অভাবিত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এজন্য তাঁর শাসনকালকে বঙ্গের মুসলমান শাসনের ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নুসরত শাহ ‘নাসিরউদ্দিন আবুল মুজাফফর নুরসত শাহ’ (১৫১৯- ১৫৩২ খ্রিঃ) উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর দক্ষতা দেখে হুসেন শাহ তার রাজত্বকালেই শাসনকার্যের কিছু কিছু ক্ষমতা নুসরত শাহকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সিংহাসনে বসেও তিনি পিতার মতো দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন। এ সময় সমগ্র বিহার তাঁর অধীনে আসে। তাঁর সময়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর বাংলা অভিযানের জন্য সৈন্য পাঠান। নুসরত শাহ প্রথমে বাবরের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। পরে যুদ্ধ শুরু হলে সন্ধি করে বাংলার সিংহাসনকে নিরাপদ রাখেন। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে নুসরত শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।
সুলতান নুসরত শাহ্ তাঁর সময়ের একজন উলে- যোগ্য শাসক ছিলেন। জনগণের প্রতি তিনি ছিলেন সহনশীল এবংখ সহৃদয়। প্রজাদের পানিকষ্ট নিবারণের জন্য তিনি রাজ্যের বহু স্থানে কূপ ও পুকুর খনন করেছিলেন। বাগেরহাটের ‘মিঠা পুকুর’ আজও তার কীর্তি ঘোষণা করছে। নুসরত শাহের মানবিক গুণাবলী তাঁকে তাঁর প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় করে তুলেছিল। হিন্দুরাও তাঁর রাজ্যে সুবিচার লাভ করত। হিন্দু-মুসলমান সমপ্রীতি এ সময়ের বৈশিষ্ট্য ছিল। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিতার কৃতিত্বকে অম-ন রেখেছিলেন।া
নুসরত শাহের শাসনকালের বহু স্থাপত্য-কীর্তি শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার পরিচয় বহন করে। গৌড়ের বিখ্যাত ‘কদম রসুল’ ভবনের প্রকোষ্ঠে তিনি একটি মঞ্চ নির্মাণ করেন। তাঁর উপর হযরত মুহম্মদের (দঃ) পদচিহ্ন সম্বলিত একটি কালো কারুকার্য খচিত মর্মর বেদি বসানো হয়। গৌড়ের সুবিখ্যাত ‘বড় সোনা মসজিদ’ বা ‘বারদুয়ারী মসজিদ’ তাঁর আমলের কীর্তি। নুসরত শাহ্ গৌড়ের অদূরে পিতার সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট নগর এবং রাজশাহী জেলার বাঘা নামক স্থানে তিনি দু’টি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর মহান কার্যসমূহের আর একটি নিদর্শন হলো সাদুলা-পুরে মহান আউলিয়া মখদুম আখি সিরাজউদ্দীনের গৌরবময় মাজারের ভিত্তি।
নুসরত শাহের আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের কিয়দংশ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর শাসনকালেই শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অশ্বমেধপর্বের বঙ্গানুবাদ করেন। শ্রীধরও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের জন্য নুসরত শাহ্ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাইব্রেরীও স্থাপন করেছিলেন।
বাংলার পরবর্তী সুলতান ছিলেন নুসরত শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহ। তিনি প্রায় এক বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নুসরত শাহের সময় থেকেই অহোম রাজ্যের সাথে বাংলার সংঘর্ষ চলছিল। ফিরোজ শাহের সময়ও তা অব্যাহত থাকে। নুসরত শাহের সময়কাল থেকেই শুরু হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানী যুগের পতন পর্ব। নুসরত শাহের উত্তরাধিকারীগণ ছিলেন দুর্বল। তাঁর ছোট ভাই গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভাইয়ের ছেলে ফিরোজ শাহকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। কিন' তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং নুসরত শাহের শাসনকালে রাজ্যে যে ভাঙ্গনের সূচনা হয়েছিল, মাহমুদ শাহের শাসনকালে তা সম্পূর্ণ হয়। তাঁর পাঁচ বছরের রাজত্বকালের উলে- যোগ্য ঘটনা আফগান নেতা শের শাহ শূরের সাথে সংঘর্ষ। অবশেষে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের শাহ গৌড় দখল করলে বাংলার দুইশত বছরের স্বাধীন সুলতানী যুগের অবসান ঘটে।
====================================================
মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: শেষ অংশ
মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: প্রথম অংশ
====================================================
.
ReplyDelete