প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: প্রথম অংশ

প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই তার স্বভাব। এভাবে বাস করতে হলে চাই একে অন্যের সাথে সহযোগিতা। এ কারণেই মানুষের প্রয়োজন পড়ে বিভিন্ন সামাজিক অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। জীবন বাঁচাতে তিনটি জিনিসের প্রথম প্রয়োজন- খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। এরপরই মানুষ জীবনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে মনোযোগ দেয় শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, আইন প্রভৃতির উন্নয়নে। সমাজ জীবন বিকাশে মানুষের এ সমস্ত কাজকর্মের একত্রিত রূপই হচ্ছে তার সংস্কৃতি। আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলার প্রাচীন মানুষেরা একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলেছিল। বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির এটাই সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। পণ্ডিতদের মতে, এদের ভাষার নাম ছিল ‘অষ্ট্রিক’। জাতি হিসেবে এদের বলা হতো নিষাদ। এরপর বাংলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায় ‘আলপাইন’ নামে এক জাতি। আর্যরা এদেশে আসার পূর্বে এরা মিলেমিশে বাংলার সংস্কৃতি গড়ে তোলে। বাঙালির জন প্রকৃতিতে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ধারা এসে মিলিত হয়েছে। ফলে তাদের ‘সংকর-জন’ হিসেবে পরিচিত করেছে। বহু বছর বিচিত্র আদান-প্রদান ও মিশ্রণের ফলে বাঙালির একটি নিজস্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়েছে। ফলে অধিকাংশ বাঙালির মাথা গোল আকৃতির, চুল কালো, চোখের মনি পাতলা হতে ঘন কালো, নাকের আকৃতি মোটামুটি মধ্যম, গায়ের রং সাধারণত শ্যামলা, মুখমণ্ডলের গঠন মধ্যম আকৃতির অর্থাৎ গোল বা লম্বা নয়। এ মধ্যম আকৃতির দেহ লক্ষণই বাঙালির বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীন বাংলার সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি

প্রাচীন বাংলার সামাজিক জীবন

মৌর্য শাসনের পূর্বে ব্যাপক অর্থে বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠেনি। এ সময়ে সমাজ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। একে বলা হতো কৌম সমাজ। আর্যদের পূর্বে কিছু কিছু ধর্মচিন্তা পরবর্তী সময়ে এদেশের হিন্দু ধর্মে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে উলে- যোগ্য হলো-কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, যোগ সাধনা ইত্যাদি। এ যুগের অনেক সামাজিক প্রথা ও আচার-আচরণের প্রভাব পরবর্তী সময়ে হিন্দু সমাজে লক্ষ করা যায়। যেমন- অতিথিদের পান-সুপারি খেতে দেয়া, শীবের গীত গাওয়া, বিয়েতে গায়ে হলুদ দেয়া, ধূতি-শাড়ি পরা এবং মেয়েদের কপালে সিঁদুর দেয়া ইত্যাদি।

আর্য সমাজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গ ছিল জাতিভেদ প্রথা। তারা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে বসবাস করার ফলে বাংলায়ও এ ব্যবস্থা চালু হয়। প্রাচীনকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এ চার প্রকার বর্ণ ছিল। পরবর্তী সময়ে আরও নানা প্রকার সঙ্কর অর্থাৎ মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়। সমাজে প্রত্যেক জাতিরই নির্দিষ্ট পেশা ছিল। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও পূজা পার্বন করা- এগুলো ছিল ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট কর্ম। তারা সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করতেন। ক্ষত্রিয়দের পেশা ছিল যুদ্ধ করা। ব্যবসা-বাণিজ্য করা ছিল বৈশ্যদের কাজ। সবচেয়ে নিচু শ্রেণির শূদ্ররা সাধারণত কৃষিকাজ, মাছ শিকার ও অন্যান্য ছোটখাটো কাজ করত। ব্রাহ্মণ ছাড়া বাকী সব বর্ণের মানুষ একে অন্যের সাথে মেলামেশা করত। সাধারণত এক জাতির মধ্যেই বিবাহ হতো, তবে উচ্চ শ্রেণির বর ও নিম্ন শ্রেণির কন্যার মধ্যে বিবাহও চালু ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসব ব্যাপারে কঠোর নিয়ম চালু হয়।

তখনকার দিনে বিদেশ ভ্রমণকারী বাঙালি পুরুষদের কোনো সুনাম ছিলনা। কিন্তু বাঙ্গালি মেয়েদের গুণাবলীর জন্য সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। সে যুগে অবরোধ বা পর্দাপ্রথা ছিলনা। তবে বাংলার মেয়েদের কোনো প্রকার স্বাধীনতা ছিলনা। একটিমাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সমাজের নিয়ম। তবে পুরুষেরা বহু স্ত্রী রাখতে পারত। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাসিতা ত্যাগ করতে হতো। স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। এ প্রথাকে বলা হয় ‘সতীদাহ প্রথা’। ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনো আইনগত অধিকার ছিলনা। বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বাঙালির উন্নত চরিত্রের কথা জানা যায়। কিন্তু তাই বলে বাঙালির সামাজিক জীবনে কোনরূপ দুর্নীতি ও অশ-লতা ছিলনা, এমন কথা বলা যায় না।

বাঙালির প্রধান খাদ্য বর্তমান সময়ের মত তখনও ছিল ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ, দধি, ঘৃত, ক্ষীর ইত্যাদি। চাউল হতে প্রস্তুত নানা প্রকার পিঠাও জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার ছিল। বাঙ্গালি ব্রাহ্মণেরা আমিষ খেতেন। তখন সকল প্রকার মাছ পাওয়া যেত। পূর্ববঙ্গে ইলিশ ও শুঁটকি মাছ খুব প্রিয় খাবার ছিল। তরকারির মধ্যে বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিংগে, কাকরুল, কচু উৎপন্ন হতো। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পেঁপে, নারকেল, ইক্ষু পাওয়া যেত। তবে ডালের কথা কোথাও বলা নেই। দুধ, নারকেলের পানি, ইক্ষুরস, তালরস ছাড়া মদ জাতীয় নানা প্রকার পানীয় সুপ্রচলিত ছিল। ভাত, গম, ইক্ষু, গুড়, মধু ও তালরস গাঁজাইয়া নানা প্রকার মদ তৈরি হতো। মদ জাতীয় নানা প্রকারের পানীয় পান করা হতো। খাওয়া-দাওয়া শেষে মসলাযুক্ত পান খাওয়ার রীতি ছিল।

পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে রাজা-মহারাজা ও ধনীদের কথা বাদ দিলে বিশেষ কোনো আড়ম্বর তখন ছিলনা। বাংলার নর-নারীরা যথাক্রমে ধূতি ও শাড়ি পরিধান করত। পুরুষেরা মালকোচা দিয়ে ধূতি পরত এবং তা হাঁটুর নিচে নামত না। মেয়েদের শাড়ি গোড়ালী পর্যন্ত পৌঁছাত। মাঝে মাঝে পুরুষেরা গায়ে চাদর, আর মেয়েরা পড়ত ওড়না। উৎসব-অনুষ্ঠানে বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল। পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই অলংকার ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। তারা কানে কুণ্ডল, গলায় হার, আঙ্গুলে আংটি, হাতে বালা ও পায়ে মল পরিধান করত। মেয়েরাই কেবলমাত্র হাতে শঙ্খের বালা পরত এবং অনেকগুলো চুড়ি পরতে ভালবাসত। মণি-মুক্তা ও দামী সোনা-রূপার অলংকার ধনীরা ব্যবহার করত। মেয়েরা নানাপ্রকার খোপা বাঁধত। পুরুষদের বাবড়ি চুল কাঁধের উপর ঝুলে থাকত। কর্পুর, চন্দন প্রভৃতি প্রসাধন সামগ্রীর সহিত বিভিন্ন সুগন্ধির ব্যবহার তখন খুব প্রচলিত ছিল। মেয়েদের সাজসজ্জায় আলতা, সিঁদুর ও কুমকুমের ব্যবহারও তখন প্রচলিত ছিল। পুরুষেরা মাঝে মধ্যে কাঠের খড়ম বা চামড়ার চটিজুতা ব্যবহার করত। তখন ছাতারও প্রচলন ছিল।

তখনকার দিনে নানা রকম খেলাধূলা ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। পাশা ও দাবা খেলা প্রচলিত ছিল। তবে নাচ- গান ও অভিনয়ের প্রচলন ছিল খুব বেশি। বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢাক, ঢোল, খোল, করতাল ইত্যাদি তো ছিলই, এমনকি মাটির পাত্রকেও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহার করা হতো। কুস্তি, শিকার, ব্যয়াম, নৌকাবাইচ ও বাজিকরের খেলা পুরুষদের খুব পছন্দ ছিল। নারীদের মধ্যে উদ্যান রচনা, জলক্রীড়া ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদের প্রচলন ছিল।

অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক আচার-আচরণ অনুষ্ঠান সে যুগেও প্রচলিত ছিল। বারো মাসে তেরো পার্বণ অনুষ্ঠিত হতো। এ উপলক্ষে নানা প্রকার আমোদ-উৎসবের ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীনকালে বাংলায় বর্তমানকালের ন্যায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া (ভাইফোঁটা), নবান্ন, রথযাত্রা, অষ্টমী স্নান, হোলি, জন্মাষ্টমী, দশহরা, অক্ষয় তৃতীয়া, গঙ্গাস্নান প্রভৃতি সুপরিচিত অনুষ্ঠানগুলো সেকালেও প্রচলিত ছিল। এসকল নানাবিধ আমোদ-উৎসব ছাড়াও হিন্দুধর্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সমাজ জীবনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, সীমন্তোন্নয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। জন্মের পর নামকরণ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি উপাচার পালন করা হতো। প্রাচীনকালে বাংলার জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন্‌ তিথিতে কি কি খাদ্য নিষিদ্ধ, কোন্‌ তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, শিশু বয়সে পড়াশুনা শুরু করা, বিদেশ যাত্রা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতির জন্য কোন্‌ কোন্‌ সময় শুভ বা অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ম কঠোরভাবে পালিত হতো।

প্রচীন বাংলার মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি ও নৌকা। খাল-বিলে চলাচলের জন্য ভেলা ও ডোঙ্গা ব্যবহার করত। মানুষ ছোট ছোট খাল পার হতো সাঁকো দিয়ে। ধনী লোকেরা হাতী, ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি প্রভৃতি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করত। তাদের স্ত্রী-পরিজনেরা নৌকা ও পালকীতে একস্থান হতে অন্য স্থানে আসা-যাওয়া করত। বিবাহের পর নববধূকে গরুর গাড়িতে বা পালকিতে করে শ্বশুর বাড়ি আনা হত। মোটের উপর মনে হয় যে, আধুনিক কালের গ্রামীণ জীবনযাত্রা এবং সেকালের জীবনযাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না।

কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলার অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত। মানুষের জীবন মোটের উপর সুখের ছিল। তবে প্রাচীন বাংলার গরিব দুঃখী মানুষের কথাও জানা যায়। সমাজের উঁচু শ্রেণি অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের হাতে ছিল মূল ক্ষমতা। এ সময় শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরাই শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা করতে পারত। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। এ উৎপাত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অধিক হতো। শেষ দিকের সেন রাজাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। সেন বংশের শাসনামলে বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতিতে নেমে আসে দুর্দশা। ব্রাহ্মণদের প্রভাবে সেনদের সময়ে সাধারণ হিন্দু সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রাচীন বাংলার শেষ পর্যায়ে এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় মুসলমান সমাজের ভিত গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে বাংলায় মধ্যযুগের সূচনা হয়। আর এ যুগে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির রূপও পাল্টে যায়।

প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা এবং শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য

প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

বাংলা চিরকালই কৃষি প্রধান দেশ। প্রাচীনকালে বাংলার অধিবাসীদের বেশির ভাগ লোকই গ্রামে বাস করত। তারা সবাই মিলে একসাথে গ্রাম গড়ে তুলত। আর গ্রামের আশপাশের ভূমি চাষ করে সংসার চালাতো। যারা চাষ করত বা অন্য কোন প্রকারে জমি ভোগ করত, বিনিময়ে তাদের কতকগুলো নির্দিষ্ট কর দিতে হতো।

প্রধানত: তিন প্রকারের ভূমি ছিল। ঘর-বাড়ি তৈরি করে থাকার জন্য উপযুক্ত জমিকে ‘বাস্তু’, চাষ করা যায় এমন উর্বর জমিকে ‘ক্ষেত্র’ এবং উর্বর অথচ পতিত জমিকে বলা হতো ‘খিল’। এ তিন প্রকারের ভূমি ছাড়াও অন্যান্য প্রকারের ভূমি ছিল। সেগুলো হলো- চারণ ভূমি, হাট-বাজার, অনুর্বর, বনজঙ্গল এবং যানবাহন চলাচলের পথ। মনে করা হয় এ সময় ভূমির মালিক ছিলেন রাজা নিজে। তখনকার দিনে ‘নল’ দিলে জমি মাপা হতো। বিভিন্ন এলাকায় নলের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকমের ছিল।

প্রাচীনকাল হতেই বঙ্গদেশ কৃষির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাই এদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষির উপর নির্ভর করে। ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এছাড়া পাট, ইক্ষু, তুলা, নীল, সর্ষে ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। ফলবান বৃক্ষের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর, খেজুর ইত্যাদি। এলাচি, লবঙ্গ প্রভৃতি মসলাও বঙ্গে উৎপন্ন হতো। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মেষ, হাঁস-মুরগি, কুকুর ইত্যাদি ছিল প্রধান। লবণ ও শুটকি দেশের কোনো কোনো অংশে উৎপন্ন হতো।

কুটির শিল্পে প্রাচীন বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। গ্রামের লোকদের দরকারি সব কিছু গ্রামেই তৈরি হতো। মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল কলস, ঘটি-বাটি, হাঁড়ি-পাতিল, বাসনপত্র ইত্যাদি। লোহার তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল দা, কুড়াল, কোদাল, খন্তা, খুরপি, লাঙ্গল ইত্যাদি। এছাড়া জলের পাত্র, তীর, বর্শা, তলোয়ার প্রভৃতি যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো। বিলাসিতার নানা রকম জিনিসের জন্য স্বর্ণ-শিল্প ও মণি-মানিক্য শিল্প অনেক উন্নতি লাভ করেছিল। কাঠের শিল্পও সে সময়ে অত্যন্ত উন্নত ছিল। সংসারের আসবাবপত্র, ঘর-বাড়ি, মন্দির, পাল্কি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, রথ প্রভৃতি কাঠের দ্বারাই তৈরি হতো। এছাড়া নদীপথে চলাচলের জন্য নানা প্রকার নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য কাঠের বড় বড় নৌকা বা জাহাজ তৈরি হতো।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান হলেও অতি প্রাচীনকাল হতে এখানে নানা প্রকার শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি হতো। বস্ত্র শিল্পের জন্য বাংলা প্রাচীনকালেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় তৈরি হতো। এ বস্ত্র এত সূক্ষ্ম ছিল যে, ২০ গজ মসলিন একটি নস্যের কৌটায় ভরা যেত। কার্পাস তুলা ও রেশমের তৈরি উন্নতমানের সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্যও বঙ্গ প্রসিদ্ধ ছিল। কার্পাস তুলা ও শনের তৈরি মোটা কাপড়ও তখন প্রস্তুত হতো। জানা যায় যে, বঙ্গদেশে সে সময় টিন পাওয়া যেত।

বঙ্গে কৃষি ও শিল্প দ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল। আবার এগুলোর খুব চাহিদাও ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাই বঙ্গের সঙ্গে প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। বঙ্গের রপ্তানী পণ্যের মধ্যে উলে- যোগ্য ছিল সূতি ও রেশমী কাপড়, চিনি, গুড়, লবণ, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা, চাউল, নারকেল, সুপারি, ঔষধখ তৈরির গাছপালা, নানা প্রকার হিরা, মুক্তা, পান্না ইত্যাদি।

শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যও যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। স্থল ও জল উভয় পথেই বাণিজ্যের আদান-প্রদান চলত। দেশের ভেতরে বাণিজ্য ছাড়াও সে সময়ে বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ উন্নত ছিল। স্থল ও জলপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলত। এ কারণে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নগর ও বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল। এগুলো হলো- নব্যাবশিকা, কোটীবর্ষ, পুন্ড্রবর্ধন, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, সপ্তগ্রাম ইত্যাদি। অবশ্য শহর ছাড়া গ্রামের হাটবাজারেও কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। এসব গ্রামের হাটে গ্রামে উৎপন্ন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচা-কেনা হতো। সমুদ্র পথে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, চম্পা, কম্বোজ, যবদ্বীপ, মালয়, শ্যাম, সুমাত্রা, চীন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলত। স্থলপথে চীন, নেপাল, ভূটান, তিব্বত ও মধ্য এশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।

শিল্পের উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বাংলার ধন-সম্পদ ও ঔশ্বর্য প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। প্রাচীনকালে হয়ত ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ‘বিনিময় প্রথা’ প্রচলিত ছিল। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকের পূর্বে বাংলায় মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয়। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশে বিভিন্ন প্রকার মুদ্রা চালু থাকলেও এখানে কড়ি সবচেয়ে কম মান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

=====================================================
>>প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: শেষ অংশ
<<প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (খ্রিঃপূর্ব ৩২৬-১২০৪ খ্রিঃ): শেষ অংশ
=====================================================

10 comments:

  1. খুব ভালো লেগেছে৷

    ReplyDelete
  2. ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে উপকৃত হয়েছি এটার মাধ্যমে। অনেক ধন্যবাদ!

    ReplyDelete
  3. খুব ই ভালো একটি উদ্যোগ ...অনেক উপকৃত হয়েছি ...আমার wbcs এর প্রস্তুতিতে প্রচন্ড সাহায্য করছে ...অনেক ধন্যবাদ ..🌷

    ReplyDelete
  4. অনেক উপকৃত হয়েছি

    ReplyDelete
  5. ভাল লাগলো।। ❤️❤️❤️

    ReplyDelete
  6. খুব ভালো লাগলো. অসাধারণ লেখা

    ReplyDelete