ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন

ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন


বাঙালিরা কখনই বিদেশি ইংরেজ শাসকদের মেনে নেয়নি। ফলে পলাশী যুদ্ধের পর পরই এদেশের কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পরাধীনতার একশ বছর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করে এদেশের সৈনিকরা ও দেশীয় রাজরাজারা। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ সমাজ। বাঙালি তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দলে দলে আত্মাহুতি দিয়ে কাঁপিয়ে তোলে ইংরেজ শাসনের ভিত। উপমহাদেশের স্বাধিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে গৌরবময় ভূমিকা ছিল বাঙালিদের। এই অধ্যায়ে ১৮৫৭ খ্রিঃ প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামসহ পরবর্তী আন্দোলনসমূহে বাঙালি তথা তৎকালীন ভারতবাসীর গৌরবের ও আত্মত্যাগের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম

পলাশী যুদ্ধের একশ বছর পর ভারতের উওর ও পূর্বাঞ্চলে প্রধানত সিপাহীদের নেতৃত্বে যে ব্যাপক সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তাকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে চরম শোষণ, সামাজিকভাবে হেয় করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, সর্বোপরি ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ-এসবই মহাবিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি রচনা করেছে। নিম্নে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো।

ইংরেজ শাসন আমলে বাংলায় প্রতিরোধ, নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন

ইংরেজ শাসন আমলে বাংলায় প্রতিরোধ, নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন

বাংলার কৃষক একসময়ে সূর্য উঠা ভোরে লাঙ্গল কাঁধে ছুটত তার ফসলের জমিতে। ফিরত অস্তগামী সূর্যকে সামনে রেখে। তার ঘরে অন্ন-বস্ত্রের প্রাচুর্য ছিল না, তবে অভাবও ছিল না। অভাব ছিল না আনন্দ-উৎসবের। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। জারি, সারি, কীর্তন, যাত্রাপালা গানে জমে উঠত গ্রাম-বাংলার সন্ধার আসর। কিন্তু সপ্তম ও অষ্টম শতকে ইংরেজ বণিক শ্রেণির আগ্রাসন কেড়ে নিতে থাকে বাংলার কৃষকের মুখের হাসি, তাদের আনন্দ- উৎসব।

প্রথমে তারা ধ্বংস করেছিল গ্রাম-বাংলার কুটির শিল্প, তারপর তাদের নজর পড়ে এদেশের উর্বর জমির উপর। অতিরিক্ত অর্থের লোভে ভূমি রাজস্ব আদায়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। যে পরীক্ষার নিষ্ঠুর বলি হয় বাংলার কৃষক-সাধারণ মানুষ। ফলে তীব্র শোষণের শিকার অসহায় কৃষক-সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ বিদ্রোহ ক্রমাগত চলতে থাকে আঠারো শতকের শেষাবধি থেকে উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত।

বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব

বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব

প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ-বিশেষ করে বাংলা অঞ্চল ছিল ধন সম্পদে পূর্ণ রূপকথার মতো একটি দেশ। এ অঞ্চলের স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রাম অর্থাৎ মানুষের জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই তখন এ সব গ্রামগুলোতে পাওয়া যেত। এই স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামের কৃষকদের ক্ষেত ভরা ফসল, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ থাকত। কুটির শিল্পেও এই গ্রামগুলো ছিল সমৃদ্ধ। তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় ইউরোপের কাপড়ের চেয়েও উন্নতমানের ছিল। এর মধ্যে জগৎ বিখ্যাত ছিল মসলিন কাপড়। তাছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলও নানা ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য, মসলার জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব পণ্যের আকর্ষণেই অনেকেই এদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে এসেছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও উপমহাদেশে এসেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। পরবর্তী সময়ে তারা এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে পরাজিত করে এবং স্থানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র করে কিভাবে ইংরেজ ব্যবসায়ী কোম্পানী এ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের সূচনা করে-বর্তমান অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: শেষ অংশ

আফগান শাসন ও বারভূঁইয়া (১৫৩৮ খ্রি: - ১৫৭৬ খ্রিঃ)

১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হলে একে একে বিদেশি শক্তিসমূহ গ্রাস করতে থাকে বাংলাকে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছুকাল বাংলার রাজধানীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন' শেষ পর্যন্ত তাঁকে আফগান নেতা শের শাহের কাছে পরাজয় মানতে হয়। বাংলা ও বিহার সরাসরি চলে আসে আফগানদের হাতে। আফগানদের দুই শাখা-শূর আফগান ও কররাণী আফগানরা বেশ কিছুকাল বাংলা শাসন করে। শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবর আফগানদের হাত থেকে বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেন। রাজধানী দখল করলেও মুঘলরা বাংলার অভ্যন্তরে অনেক দিন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এ সময় বাংলায় অনেক বড় বড় স্বাধীন জমিদার ছিলেন। ‘বার ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত এ সমস্ত জমিদার মুঘলদের অধিকার মেনে নেননি। সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সুবাদারগণ ‘বার ভূঁইয়াদের’ দমন করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। ‘বার ভূঁইয়াদের’ দমন করা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে।

আফগান শাসন

মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুন হুসেনশাহী যুগের শেষদিক থেকেই চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে মুঘল অধিকারে নিয়ে আসতে। কিন' আফগানদের কারণে মুঘলদের এ উদ্দেশ্য প্রথম দিকে সফল হয়নি। আফগান নেতা শের খান শূরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সম্রাট হুমায়ুন। শের খানের পিতা হাসান খান শূর বিহারে অবসি'ত সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি জায়গিরদার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এ সময় বিহারের জায়গিরদার জালাল খান নাবালক বলে তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শের খান।

সমগ্র ভারতের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন ছিল শের খানের। তাই গোপনে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। এ লক্ষ্যে অল্প সময়ের মধ্যে শের খান শক্তিশালী চুনার দুর্গ ও বিহার অধিকার করেন। তিনি ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে দু’বার বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। এবার সতর্ক হন দিল্লির মুঘল সম্রাট হুমায়ুন। তিনি শের খানের পিছু ধাওয়া করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নেন। গৌড়ের চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন এর নামকরণ করেন ‘জান্নাতবাদ’। সম্রাট গৌড়ে ৬ মাস আমোদ ফূর্তিতে গা ভাসিয়ে দেন। এ সুযোগে নিজের শক্তি বাড়াতে থাকেন শের খান। দিল্লি থেকে খবর আসে হুমায়ুনের সৎভাই হিন্দাল সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্র করছেন। এ খবর পেয়ে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করেন। এ সুযোগ কাজে লাগান শের খান। তিনি ওঁত পেতে থাকেন বক্সারেরী নিকট চৌসা নাম স্থানে। গঙ্গা নদীর তীরে এ স্থানে হুমায়ুন পৌঁছালে শের খান তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপ্রস'ত হুমায়ুন পরাজিত হন (১৫৩৯ খ্রিঃ)।

মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: দ্বিতীয় অংশ

বাংলায় স্বাধীন সুলতানী শাসনের ইতিহাস

দিল্লির সুলতানগণ ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খিস্টাব্দ পর্যন- দুইশত বছর বাংলাকে তাঁদের অধিকারে রাখতে পারেননি। প্রথমদিকে দিল্লির সুলতানের সৈন্যবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে বাংলাকে নিজের অধিকারে আনার জন্য। অবশেষে সফল হতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এ সময়ে বাইরের অন্য কোনো আক্রমণেরও তেমন সম্ভাবনা ছিলনা। তাই বাংলার সুলতানগণ স্বাধীনভাবে এবং নিশ্চিনে- এদেশ শাসন করতে পেরেছেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের হাতে বাংলা প্রথম সি'তিশীলতা লাভ করে।

স্বাধীন সুলতানী আমল (১৩৩৮ খ্রিঃ - ১৫৩৮ খ্রিঃ)

১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যু হয়। বাহরাম খানের বর্মরক্ষক ছিলেন ‘ফখরা’ নামের একজন রাজকর্মচারী। প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন। এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের। দিল্লির মুহম্মদ-বিন-তুঘলকেরী এ সময় সুদূর বাঙলার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ ছিলনা। তাই সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীন অঞ্চলের সীমা বিসতৃত হতে থাকে। পরবর্তী দুইশত বছর এ স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।

সোনারগাঁওয়ের বাইরে লখনৌতির শাসনকেন্দ্রে তখন দিল্লির শাসনকর্তাগণ শাসন করতেন। তাঁরা ফখরুদ্দিনেরী স্বাধীনতা ঘোষণাকে সুনজরে দেখেননি। তাই লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন মিলিতভাবে সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেননি। কদর খান ফখরুদ্দিনের সৈন্যদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।

মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস: প্রথম অংশ

মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস

(১২০৪ খ্রিঃ-১৭৫৭ খ্রিঃ)

বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনাকালকে বাংলায় মধ্যযুগের শুরু বলা হয়। ইতিহাসে এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবেশ করতে হলে বিশেষ কতকগুলো যুগান্তকারী পরিবর্তন দরকার। মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের ফলে বঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই শুধু পরিবর্তন আসেনি। এর ফলে বঙ্গের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ দেশবাসীর জীবনে বৈপ-বক পরিবর্তন আসে।

বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি

তেরো শতকের শুরুতে তুর্কী বীর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। তিনি আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী ছিলেন। ইতিহাসে তিনি বখতিয়ার খলজি নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর বংশ পরিচয় সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কী, বংশে খলজি এবং বৃত্তিতে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক।

বখতিয়ার খলজি স্বীয় কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজ জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে জীবিকার অন্বেষণে গজনীতে আসেন। এখানে তিনি শিহাবউদ্দিন ঘোরীর সৈন্য বিভাগে চাকরি প্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। খাটো, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার জন্য নিশ্চয়ই বখতিয়ার সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হন। এরূপ শারীরিক বৈশিষ্ট্য তুর্কীদের নিকট অমঙ্গল বলে বিবেচিত হতো। গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল-তে সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবেকেরী দরবারে উপসিথত হন। এবারও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি বদাউনে যান। সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দিন তাকে মাসিক বেতনে সৈন্য বিভাগে নিযুক্ত করেন। কিনু্ত উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার এ ধরনের সামান্য বেতনভোগী সৈনিকের পদে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। অল্পকাল পর তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যা যান। সেখানকার শাসনকর্তা হুসামউদ্দীনের অধীনে তিনি পর্যবেনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। বখতিয়ারের সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় সন্তুষ্ট হয়ে হুসামউদ্দীন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ভাগবত ও ভিউলি নামক দুটি পরগনার জায়গীর দান করেন। এখানে বখতিয়ার তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান। ভাগবত ও ভিউলি তার শক্তিকেন্দ্র হয়ে উঠে।

প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: শেষ অংশ

প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: শেষ অংশ

শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য

বাংলাদেশের নানাস্থানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের বহু নির্দশন পাওয়া গেছে। নানাবিধ কারণে প্রাচীন বাংলার শিল্পকলা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রাচীন যুগে বাংলার শিল্পকলা খুবই উন্নত ছিল।

স্থাপত্য : প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন অতি সামান্যই আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন দেশের ভ্রমণকারী ফা-হিয়েন ও হিউয়েন-সাং- এর বিবরণী ও প্রাচীন শিলালিপি থেকে প্রাচীন যুগে বাংলার কারুকার্যময় বহু হর্ম্য, (চূড়া, শিখা) মন্দির, স্তূপ ও বিহারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।

ভারত উপ-মহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যের নির্দশন হলো স্তূপ। বৈদিক যুগে দেহাবশেষ পুঁতে রাখার জন্য শ্মশানের উপর মাটির স্তূপ রক্ষা করার জন্য এ স্থাপত্য পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হয়। বৌদ্ধধর্ম যেখানেই প্রসার লাভ করেছে, সেখানেই ছোট-বড় অসংখ্য স্তূপ নির্মিত হয়েছে। প্রাচীন বাংলায় কিছু বৌদ্ধ ও জৈন স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। ঢাকা জেলার আশরাফপুর গ্রামে রাজা দেব খড়গের ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতু নির্মিত একটি স্তূপ পাওয়া গেছে। এটিই সম্ভবত বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন স্তূপের নির্দশন। রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং চট্টগ্রামের ঝেওয়ারিতে আরও দুটি ব্রোঞ্জের তৈরি স্তূপ পাওয়া গেছে। এছাড়া, রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং বাঁকুড়ার বহুলাড়ায় বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটের তৈরি স্তূপ পাওয়া গেছে।

অতি প্রাচীনকাল হতে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুরা বিহার ও সংঘরাম তৈরি করে স্ব স্ব ধর্ম প্রচার করতেন। কিন্তু একে স্থাপত্য কর্ম বলা চলে না। কারণ, ইট-পাথরের কাঠামোর উপর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি হতো। কালক্রমে বৌদ্ধ ও জৈন সংঘে যখন প্রচারকের সংখ্যা বাড়তে লাগল তখন হতেই ইটের তৈরি বিহার প্রস্তুত শুরু হলো। পাল যুগে এসেই বিহারের রূপের পরিবর্তন হলো। এসব বিহারের কোনো কোনটি বেশ বড় এবং কারুকার্যময় ছিল। স্তূপের মত এগুলোও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। রাজশাহীর পাহাড়পুরে যে বিশাল বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে যত বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তারমধ্যে এ বিহারটি সবচেয়ে বড়। জানা যায়, অষ্টম শতকে ধর্মপাল এখানে প্রকাণ্ড বিহারটি নির্মাণ করেন। ‘সোমপুর বিহার’ নামে এটি সমগ্র ভারতবর্ষে ও ভারতবর্ষের বাইরে খ্যাতি অর্জন করে। সোমপুর বিহার ব্যতীত ধর্মপাল বিক্রমশীল বিহার ও ওদন্তপুর বিহার নামে আরও দুটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া পাল আমলে তৈরি ছোট-বড় আরও কয়েকটি বিহারে নাম পাওয়া যায়। যেমন-মালদহের ‘জগদুল বিহার’, ‘দেবীকোট বিহার’, চট্টগ্রামের ‘পণ্ডিত বিহার’, ত্রিপুরার ‘কনকস্তূপ বিহার’ প্রভৃতি। কয়েক বছর পূর্বে কুমিল-র ময়নামতিতে কয়েকটি বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইহা ‘শালবল বিহার’ নামে পরিচিত।া কেহ কেহ মনে করেন যে, পাহাড়পুরের বিহার ও মন্দির অপেক্ষাও বড় মন্দির ও বিহার এখানে ছিল।