প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (খ্রিঃপূর্ব ৩২৬-১২০৪ খ্রিঃ):প্রথম অংশ

প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (খ্রিঃপূর্ব ৩২৬-১২০৪ খ্রিঃ)

পাল রাজাদের শাসনকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এর আগের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। এ সময়কালে কোনো শাসক দীর্ঘদিন সমগ্র বাংলা জুড়ে শাসন করতে পারেননি। তাই বিচ্ছিন্নভাবেই বাংলার রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ ঘটেছে। মৌর্য ও গুপ্ত শাসনের অবসানের পর এক অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরই মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে কিছু স্বাধীন রাজ্যের। স্বাধীন রাজ্য উত্থানের যুগে উত্তর বাংলার রাজা শশাংক ছিলেন সবচেয়ে শক্তিমান। তাঁর মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলেন না। ফলে রাজ্য জুড়ে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রায় একশত বছর এ অবস্থার মধ্যে কাটে। অতঃপর গোপাল নামে এক নেতা এ অরাজক অবস্থার অবসান ঘটান এবং পাল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। বারো শতকের মাঝামাঝি পাল বংশের পতন ঘটে। পাল শাসন যুগেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠে। এরপর দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট থেকে আগত সেন বংশ পূর্ব বাংলায় রাজ্য স্থাপন করে। প্রায় দুইশত বছর সেন শাসন অব্যাহত ছিল। তের শতকের প্রথম দশকে মুসলমান শক্তির হাতে সেন রাজত্বের অবসান ঘটে। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়- বাংলার মধ্যযুগ।

প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ ও শাসন-ব্যবস্থা

মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বাংলা

গুপ্ত যুগের পূর্বে প্রাচীন বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করার তেমন কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। কেননা তখনকার মানুষ আজকের মতো ইতিহাস লেখায় অভ্যস্ত ছিল না। ভারতীয় এবং বিদেশি সাহিত্যে এ সময়কার বাংলা সম্পর্কে ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত উক্তি হতে আমরা ইতিহাসের অল্পস্বল্প উপাদান পাই। এ সকল বিচ্ছিন্ন ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে সন-তারিখ ও প্রকৃত ঘটনা সম্বলিত ধারাবাহিক কোনো ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বস্তুত, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭- ২৬ অব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় হতে প্রকৃত ইতিহাসের রূপ পরিগ্রহ করে। গ্রীক লেখকদের কথায় তখন বাংলাদেশে ‘গঙ্গারিডই’ নামে এক শক্তিশালী রাজ্য ছিল। গঙ্গা নদীর যে দুটি স্রোত এখন ভাগীরথী ও পদ্মা বলে পরিচিত-এ উভয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলই ‘গঙ্গারিডই’ জাতির বাসস্থান ছিল। গ্রীক গ্রন্থকারগণ গঙ্গারিডই ছাড়াও ‘প্রাসিঅয়’ নামে অপর এক জাতির উলে- করেছেন। তাদের রাজধানীর নাম ছিল পালিবোথরাখ (পাটলিপুত্র)। গ্রীক লেখকদের বর্ণনার উপর নির্ভর করে অনুমান করা যেতে পারে যে এ দু জাতি একই রাজবংশের নেতৃত্বে একসঙ্গে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। এও অনুমান করা যেতে পারে, আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় বাংলার রাজা মগধাদি দেশ জয় করে পাঞ্জাব পর্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি ছিলেন পাটলিপুত্রের নন্দবংশীয় কোনো রাজা। এ সময় যে বাংলার রাজাই সমধিক শক্তিশালী ছিলেন প্রাচীন গ্রীক লেখকগণের উক্তি থেকে তা নি:সন্দেহে প্রমাণিত হয়।
আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের মাত্র দুই বছর পর ৩২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের এক বিশাল অঞ্চলের উপর মৌর্য বংশের প্রভুত্ব স্থাপন করেন। উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২ খ্রিঃপূঃ)। অঞ্চলটি মৌর্যদের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীন পুন্ড্রনগর ছিল এ প্রদেশের রাজধানী। উত্তর বঙ্গ ছাড়াও মৌর্য শাসন কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ), তাম্রলিপ্ত, (হুগলী) ও সমতট (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ ও পরে কন্ব বংশের আবির্ভাব ঘটে। এ যুগের ইতিহাস জানার মতো যথেষ্ট উপাদান আমাদের কাছে নেই। ধারণা করা হয় তারা কিছু ছোট অঞ্চলের উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরপর বেশ কটি বিদেশি শক্তি ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। এদের মধ্যে গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ প্রভৃতি উলে- যোগ্য। তবে এ আক্রমণকারীরাখ বাংলা পর্যন্ত এসেছিল কি-না তা বলা যায় না।
গুপ্ত যুগ সম্পর্কে জানার মতো বেশ কিছু উপাদান ইতিহাসবিদদের হাতে রয়েছে। এ থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষভাগ ও চতুর্থ শতকের প্রথম ভাগের ইতিহাস রচনা সহজ হয়েছে। ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ৩২০ খ্রিস্টাব্দে। তখন বাংলায় বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট রাজ্য ও পশ্চিম বাংলার পুষ্করণ রাজ্য উলে- যোগ্য। গুপ্ত সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই উত্তর বঙ্গের কিছু অংশ গুপ্তখ সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে সমগ্র বাংলা জয় করা হলেও সমতট একটি করদ রাজ্য ছিল। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল হতে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্থ একটি ‘প্রদেশ’ বা ‘ভুক্তি’ হিসেবে পরিগণিত হতো। মৌর্যদের মত এদেশে গুপ্তদের রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়ের পুন্ড্রনগর।

গুপ্ত পরবর্তী বাংলা

পাঁচ শতকে দুর্ধর্ষ পাহাড়ি জাতি হুন ও ষষ্ঠ শতকে মালবের যশোবর্মণের আক্রমণের ফলে ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধেই গুপ্ত শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়। এভাবে গুপ্তদের পর সমগ্র উত্তর ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সে সুযোগে বাংলাদেশে দুটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এর একটি হলো বঙ্গ। এর অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম-বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে। দ্বিতীয় রাজ্যের নাম গৌড়। এর অবস্থান ছিল বাংলার পশ্চিম ও উত্তর বাংলা নিয়ে।

স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য

গুপ্ত সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে বঙ্গ জনপদে একটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। তাম্র শাসন (তামার পাতে খোদাই করা রাজার বিভিন্ন ঘোষণা বা নির্দেশ) থেকে জানা যায় যে, গোচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামে তিনজন রাজা স্বাধীন বঙ্গরাজ্য শাসন করতেন। এঁরা সবাই ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের রাজত্বকাল ছিল ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
কোন্‌ সময়ে এবং কীভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী বঙ্গ রাজ্যের পতন হয়েছিল তা বলা যায় না। ধারণা করা হয়, দাক্ষিণাত্যের চালুক্য বংশের রাজা কীর্তিবর্মনের হাতে স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটেছিল। ভিন্ন মত যাঁরা পোষণ করেন তাঁরা বলেন, স্বাধীন গৌড় রাজ্যের উত্থান ঘটলে বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটে। আবার স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতনের পেছনে কিছু সামন্ত রাজার উত্থানকেও দায়ী করা হয়। কারণ, সাত শতকের পূর্বেই দক্ষিণ বাংলার সমতট রাজ্যে ভদ্র, খড়গ, রাঢ় প্রভৃতি বংশের স্বাধীন ও সামন্ত রাজাদের উত্থান ঘটেছিল।

স্বাধীন গৌড় রাজ্য

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ছয় শতকে ‘পরবর্তী গুপ্ত বংশ’ বলে পরিচিত গুপ্ত উপাধিধারী রাজাগণ উত্তর বাংলা, পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশ ও মগধে ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। ছয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলই গৌড় জনপদ নামে পরিচিতি লাভ করে। মৌখরী ও পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজাদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর পুরুষানুক্রমিক সংঘর্ষ এবং উত্তর থেকে তিব্বতীয় ও দাক্ষিণাত্য থেকে চালুক্যরাজগণের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে বাংলায় গুপ্তবংশীয় রাজাগণ দুর্বল হয়ে পড়েন। এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে শশাংক নামে জনৈক সামন্ত সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে গৌড় অঞ্চলে ক্ষমতা দখন করেন এবং স্বাধীন গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
শশাংক : শশাংকের পরিচয়, তাঁর উত্থান ও জীবন-কাহিনী আজও পণ্ডিতদের নিকট পরিষ্কার নয়। কেননা তাঁর আমলের ইতিহাসের যে সমস্ত উপাদান পাওয়া গেছে তাতে বহু বিপরীতমুখী বর্ণনা রয়েছে। গুপ্ত রাজাদের অধীনে বড় কোনো অঞ্চলের শাসককে বলা হতো ‘মহাসামন্ত’। ধারণা করা হয় শশাংক ছিলেন গুপ্ত রাজা মহাসেনগুপ্তের একজন ‘মহাসামন্ত’ এবং তাঁর পুত্র অথবা ভ্রাতুষ্পুত্র।
শশাংক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। তিনি গৌড়ে তাঁর অধিকার স্থাপন করে প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার শুরু করেন। তিনি দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর) রাজ্য, উড়িষ্যার উৎকল (উত্তর উড়িষ্যা) ও কঙ্গোদ (দক্ষিণ উড়িষ্যা) রাজ্য এবং বিহারের মগধ রাজ্য জয় করে তাঁর রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। পশ্চিমে তাঁর রাজ্য বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কামরুপের (আসাম) রাজাও শশাংকের হাতে পরাজিত হন। এরপর তিনি পশ্চিম সীমান্তের দিকে মনোযোগ দেন। উত্তর ভারতে এ সময় দুজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। একটি পুষ্যভূতি রাজবংশের অধীনে থানেশ্বর এবং অন্যটি মৌখরী রাজবংশের অধীনে কান্যকুব্জ। পশ্চিম দিক থেকে কনৌজের মৌখরী শক্তি বাংলা অধিকারের জন্য বার বার চেষ্টা করছিল। তদুপরি সমসাময়িক সময়ে থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর সঙ্গে কনৌজের মৌখরী রাজা গ্রহবর্মণের বিয়ে হলে কনৌজ-থানেশ্বর জোট গড়ে উঠে। এ জোটের ফলে বাংলার নিরাপত্তা বিশেষভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে শশাংকও কূটনৈতিক সূত্রে মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করেন।
পরাক্রান্ত থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধনের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে তাঁর জামাতা কনৌজের গ্রহবর্মণ সিংহাসনে বসেন। মালবরাজ দেবগুপ্ত মৌখরিরাজ গ্রহবর্মণকে পরাজিত করেন। তাঁর মহিষী রাজ্যশ্রীকে বন্দী করা হয়। দেবগুপ্ত এরপর থানেশ্বরের দিকে অগ্রসর হন। থানেশ্বরের রাজা তখন রাজ্যবর্ধন। পথিমধ্যে দেবগুপ্ত রাজ্যবর্ধনের হস্তে পরাজিত ও নিহত হন। কিন্তু কনৌজের উপর নিজ প্রভুত্ব বিস্তার ও ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার আগেই তিনি শশাংকর হাতে মৃত্যুবরণ করেন।
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হলে হর্ষবর্ধন কনৌজ ও থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি কাল বিলম্ব না করে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য শশাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এ সময় কামরূপের ভাস্করবর্মা তাঁর সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হন। কিন্তু এ সংঘর্ষের ফলাফল বা আদৌ কোনো সংঘর্ষ হয়েছিল কি-না সে বিষয়ে সঠিকভাবে জানা যায় না। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে শশাংক মৃত্যুবরণ করেন।
শশাংক শৈব ধর্মের উপাসক ছিলেন। হিউয়েন-সাং তাঁকে বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। সাত শতকে বাংলার ইতিহাসে শশাংক একটি বিশিষ্ট নাম। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে তিনিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম শাসক।

মাৎসান্যায় ও পাল বংশ (৭৫০ খ্রিঃ - ১১৬১ খ্রিঃ)

শশাংকের মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে এক দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারময় যুগের সূচনা হয়। দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলেন না। ফলে, রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। একদিকে হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মণের হাতে গৌড় রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়, অন্যদিকে ভূ-স্বামীরা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় একে অন্যের সাথে সংঘাতে মেতে উঠে। কেন্দ্রীয় শাসন শক্ত হাতে ধরার মতো তখন কেউ ছিলেন না। এ অরাজকতার সময়কালকে পাল তাম্রশাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘মাৎসান্যায়’ বলে। পুকুরে বড় মাছ ছোট মাছকে ধরে গিলে ফেলার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে ‘মাৎসান্যায়’। বাংলার সবল অধিপতিরা এমনি করে ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করছিল। এ অরাজকতার যুগ চলে একশত বছরব্যাপী। আট শতকের মাঝমাঝি এ অরাজকতার অবসান ঘটে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে।
দীর্ঘদিনের অরাজকতায় বাংলার মানুষের মন বিষিয়ে গিয়েছিল। এ চরম দুঃখ-দুর্দশা হতে মুক্তি লাভের জন্য দেশের প্রবীণ নেতাগণ স্থির করলেন যে তারা পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করবেন এবং সকলেই স্বেচ্ছায় তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করবেন। দেশের জনসাধারণও এ মত সানন্দে গ্রহণ করে। এর ফলে গোপাল নামক এক ব্যক্তি রাজপদে নির্বাচিত হলেন। পরবর্তী শাসক ধর্মপালের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ খালিমপুরের তাম্রলিপি হতে গোপালের এ নির্বাচনের কাহিনী পাওয়া যায়। গোপালের সিংহাসন আরোহণ নিয়ে তিব্বতের ঐতিহাসিক লামা তারনাথ অবশ্য এক রূপকথার অবতারণা করেছেন। তাঁর কাহিনীর সারকথা : দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ অরাজকতার ফলে জনগণের দু:খ-কষ্টের আর সীমা ছিল না। দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিরা একমত হয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একজন ‘রাজা’ নির্বাচিত করেন। কিন্তু ‘নির্বাচিত রাজা’ রাতে এক কুৎসিত নাগ রাক্ষসী কর্তৃক নিহত হন। এরপর প্রতি রাতেই একজন করে ‘নির্বাচিত রাজা’ নিহত হতে থাকেন। এভাবে বেশ কিছু বছর কেটে গেল। অবশেষে একদিন চুন্ডাদেবীর এক ভক্ত এক বাড়িতে এসে দেখে সে বাড়ির সকলেরই মন খুব খারাপ। কারণ, ঐদিন ‘নির্বাচিত’ রাজা হবার ভার পড়েছে ঐ বাড়িরই এক ছেলের উপর। আগন্তুক ঐ ছেলের পরিবর্তে নিজে রাজা হতে রাজি হন। পরবর্তী সকালে তিনি রাজা ‘নির্বাচিত’ হন। সে রাত্রে নাগ রাক্ষুসী এলে তিনি চুন্ডাদেবীর মহিমাযুক্ত লাঠির আঘাতে রাক্ষুসীকে মেরে ফেলেন। পরের দিন তাকে জীবিত দেখে সকলেই আশ্চর্য হয়। পরপর সাতদিন তিনি এভাবে রাজা ‘নির্বাচিত’ হন। অবশেষে তাঁর অদ্ভুত যোগ্যতার জন্য জনগণ তাঁকে স্থায়ীভাবে রাজা রূপে ‘নির্বাচিত’ করে।
গোপালের পূর্ব জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। পাল বংশের পরিচয় ও আদি বাসস্থান সম্পর্কেও স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। গোপালের পিতার নাম বপ্যট। তিনি ছিলেন ‘শত্রু ধ্বংসকারী’। পিতামহ ছিলেন দয়িতবিষ্ণু। তাদের নামের আগে কোন রাজকীয় উপাধি দেখা যায়নি। এতে মনে করা হয়, তারা সাধারণ ব্যক্তিই ছিলেন। দয়িতবিষ্ণু ‘সর্ববিদ্যা বিশুদ্ধ’ ছিলেন। এ থেকে মনে হয়, গোপালও পিতার মতো সুনিপুণ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গোপালের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে বাংলায় পাল রাজত্বের শুরু হয়। পাল বংশের রাজাগণ একটানা চারশত বছর এদেশ শাসন করেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোন রাজবংশ এদেশ শাসন করেনি।
গোপাল সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দেন। তিনি বাংলার উত্তর এবং পূর্ব অংশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলই রাজ্যভুক্ত করেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা গোপালের শাসনের বাইরে থেকে যায়। অনেকের মতে গোপাল ২৭ বৎসর শাসন করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন, তিনি ৭৫৬ থেকে ৭৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।
গোপালের মৃত্যুর পর ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ খ্রিঃ) বাংলার সিংহাসনে বসেন। পাল রাজাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। বাংলা ও বিহারব্যাপী তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ সময়ে তিনটি রাজবংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। একটি বাংলার পাল, অন্যটি রাজপুতনার গুর্জরপ্রতিহার ও তৃতীয়টি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট। ইতিহাসে এ যুদ্ধ ‘ত্রি-শক্তির সংঘর্ষ’ বলে পরিচিত। আট শতকের শেষ দিকে এ যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম যুদ্ধ হয় ধর্মপাল ও প্রতিহার বংশের রাজা বৎসরাজার মধ্যে। এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন। তবুও ধর্মপাল এ সময় বাংলার বাইরে বেশকিছু অঞ্চল জয় করেছিলেন। তিনি বারাণসী ও প্রয়াগ জয় করে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। ত্রি-শক্তির সংঘর্ষের প্রথম দিকে ধর্মপাল পরাজিত হলেও তাঁর বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। কারণ, বিজয়ের পর রাষ্ট্রকূটরাজ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান। এ সুযোগে ধর্মপাল কনৌজ অধিকার করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিহাররাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজ দখল করেন। ফলে, ধর্মপালের সাথে তাঁর যুদ্ধ বাঁধে। এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন। এ পরাজয়েও ধর্মপালের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ, পূর্বের মতো রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতে আসেন এবং দ্বিতীয় নাগভট্টকে পরাজিত করেন। প্রতিহার রাজের পরাজয়ের পর ধর্মপালও তৃতীয় গোবিন্দের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। অতঃপর রাষ্ট্রকূটরাজ তাঁর দেশে ফিরে গেলে ধর্মপাল পুনরায় উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করেন। কেহ কেহ মনে করেন, ধর্মপাল নেপালও জয় করেছিলেন। ধর্মপাল প্রায় ৪০ বৎসর (৭৮১-৮২১ খ্রিঃ) রাজত্ব করেন।
সোমপুর বিহার, পাহাড়পুর, নওগা
সোমপুর বিহার, পাহাড়পুর, নওগা
পিতার মতো ধর্মপাল বৌদ্ধ ছিলেন। পাল রাজাদের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ সার্বভৌম উপাধি পরমেশ্বর, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ ধারণ করেছিলেন। ভাগলপুরের ২৪ মাইল পূর্বে তিনি একটি বৌদ্ধ বিহার বা মঠ নির্মাণ করেন। বিক্রমশীল তাঁর দ্বিতীয় নাম বা উপাধি অনুসারে এটি ‘বিক্রমশীল বিহার’ নামে খ্যাত ছিল। নালন্দার মতো বিক্রমশীল বিহারও ভারতবর্ষের সর্বত্র ও ভারতবর্ষের বাইরে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এটি সমগ্র ভারতবর্ষের একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তিব্বতের বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে অধ্যয়ন করতে আসতেন এবং এখানকার অনেক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য তিব্বতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। নাটোর জেলার পাহাড়পুর নামক স্থানেও ধর্মপাল এক বিশাল বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ইহা সোমপুর বিহার নামে পরিচিত। এই স্থাপত্য কর্মটি জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে (ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ) স্বীকৃত হয়েছে। এর ন্যায় প্রকাণ্ড বিহার ভারতবর্ষের আর কোথাও এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। ওদন্তপুরেও (বিহার) তিনি সম্ভবত একটি বিহার নির্মাণ করেন। তারনাথের মতে, ধর্মপাল বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার জন্য ৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাজা হিসেবে সকল ধর্মাবলম্বী প্রজার প্রতি সমান পৃষ্ঠপোষকতা পাল যুগের একটি বৈশিষ্ট্য। তাই নিজে বৌদ্ধ হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি ধর্মপালের কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজার ব্যক্তিগত ধর্মের সহিত রাজ্য শাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তিনি শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চলতেন এবং প্রতি ধর্মের লোক যাতে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে তার প্রতি খেয়াল রাখতেন। নারায়নের একটি হিন্দু মন্দিরের জন্য তিনি করমুক্ত ভূমি দান করেছিলেন। তিনি যাদেরকে ভূমি দান করেছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিল ব্রাহ্মণ। ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী গর্গ ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ। তাঁর বংশধরেরা বহুদিন ধরে পাল রাজাদের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে খ্যাতিমান সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে ধর্মপাল অন্যতম। অর্ধ শতাব্দী পূর্বে যে দেশ অরাজকতা ও অত্যাচারের লীলাভূমি ছিল, তাঁর নেতৃত্বে সে দেশ সহসা প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উত্তর ভারতে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল (৮২১ খ্রিঃ-৮৬১ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। তিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। পিতার ন্যায় তিনিও বাংলার রাজ্যসীমা বিস্তারে সফল হন। দেবপাল উত্তর ভারতে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট রাজাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। উত্তর ভারতের বিশাল অঞ্চল তাঁর অধিকারে এসেছিল। উড়িষ্যা ও কামরূপের উপরও তিনি আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। মোট কথা, তাঁর সময়েই পাল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল। দেবপাল বৌদ্ধ ধর্মের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মগধের বৌদ্ধ মঠগুলোর তিনিই সংস্কার সাধন করেন। তিনি নালন্দায় কয়েকটি মঠ এবং বুদ্ধগয়ায় এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মুঙ্গেরে তিনি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। জাভা, সুমাত্রা ও মালয়ের শৈলেন্দ্র বংশের মহারাজ বালপুত্রদেবকে নালন্দায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এ মঠের ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রামও প্রদান করা হয়। এ ঘটনা হতে বাংলা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়।
দেবপাল বিদ্যা ও বিদ্বানের প্রতি অতিশয় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তখন সমগ্র এশিয়ায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ইন্দ্রগুপ্ত নামক জনৈক বৌদ্ধ শাস্ত্রে পারদর্শী ব্রাহ্মণকে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন। এ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই তাঁর শাসন আমলে উত্তর-ভারতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধধর্ম পুনরায় সজিব হয়ে উঠে।
দেবপালের মৃত্যুর পর থেকে পাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকজন দুর্বলচেতা ও অকর্মন্য উত্তরাধিকারী সিংহাসনে বসেন। তাঁরা পাল সাম্রাজ্যের গৌরব ও শক্তি অব্যাহত রাখতে পারেননি। ফলে পাল সাম্রাজ্য ক্রমেই পতনের দিকে ধাবিত হয়। দেবপালের পুত্র প্রথম বিগ্রহপাল থেকে দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকাল ৮৬১ হতে ৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রথম বিগ্রহপালের পুত্র নারায়ণপাল (৮৬৬-৯২০ খিস্টাব্দ) দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। তিনি একজন দুর্বল উদ্যমহীন শাসক ছিলেন। ফলে, তাঁর রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্যের সীমা ছোট হতে থাকে। নারায়ণ পালের পর একে একে পাল সিংহাসনে বসেন রাজ্যপাল, দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপাল। এঁরা আনুমানিক ৯২০ হতে ৯৯৫ খিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময় পাল রাজাদের শাসন ক্ষমতা কেবল গৌড় ও তার আশপাশেই সীমাবদ্ধ ছিল। এসব দুর্বল রাজার সময়ে উত্তর ভারতের চন্দেল-ও কলচুরি বংশের রাজাদের আক্রমণে পাল সাম্রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে, এ সময়ে পাল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম বাংলার অংশ বিশেষে কম্বোজ রাজবংশের উত্থান ঘটে।
এভাবে পাল সাম্রাজ্য যখন ধ্বংসের মুখে, তখন আশার আলো নিয়ে এগিয়ে এলেন দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সুযোগ্য পুত্র প্রথম মহীপাল (আঃ ৯৯৫-১০৪৩ খ্রিঃ)। তাঁর জীবনের সবচেয়ে উলে- যোগ্য কীর্তি হলো কম্বোজ জাতির বিতাড়ন এবংখ পূর্ব বঙ্গ অধিকার করে পাল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এরপর তিনি রাজ্য বিজয়ে মনোযোগ দেন। তাঁর সাম্রাজ্য পূর্ব বঙ্গ হতে বারানসী এবং মিথিলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। সে সময়ে ভারতের দুই প্রবল রাজশক্তি তামিলরাজ রাজেন্দ্র চোল এবং চেদীরাজ গাঙ্গেয়দেবের আক্রমণ হতে তিনি রাজ্যের অধিকাংশ স্থানে স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মহীপাল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। মনে প্রাণে তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের উদার পৃষ্ঠপোষক। পুরাতন কীর্তি রক্ষায় তিনি যত্নবান ছিলেন। তিনি নালন্দায় এক বিশাল বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন। বারানসীতেও তাঁর আমলে কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করা হয়।
মহিপাল জনকল্যাণকর কার্যের দিকেও মনোযোগী ছিলেন। বাংলার অনেক দীঘি ও নগরী এখনও তাঁর নামের সহিত জড়িত হয়ে আছে। তিনি অসংখ্য শহর প্রতিষ্ঠা ও দীঘি খনন করেন। শহরগুলো হলো রংপুর জেলার মাহীগঞ্জ, বগুড়া জেলার মহীপুর, দিনাজপুর জেলার মাহীসন্তোষ ও মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপাল নগরী। আর দীঘিগুলোর মধ্যে দিনাজপুরের মহীপাল দীঘি ও মুর্শিদাবাদের মহীপালের সাগর দীঘি বিখ্যাত। সম্ভবত জনহিতকর কাজের মাধ্যমেই মহীপাল এ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
মহীপালের পঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালে পাল বংশের সৌভাগ্য রবি আবার উদিত হয়েছিল। এ জন্যই ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পাল সাম্রাজ্যের দ্রুত অবনতির যুগে প্রথম মহীপালের আবির্ভাব না ঘটলে এ সাম্রাজ্যের রাজত্বকালের সময়কাল নিঃসন্দেহে আরও সঙ্কুচিত হতো।
কিন্তু মহীপাল কোন যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি। তাই তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে শুরু করে। প্রথম মহীপালের পর তাঁর পুত্র ন্যায়পাল (আ: ১০৪৩-১০৫৮ খ্রিঃ) ও পৌত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল (আ: ১০৫৮- ১০৭৫ খ্রিঃ) পাল সিংহাসনে বসেন। এ দুর্বল রাজাদের সময় কলচুরি রাজা, কর্ণাটের চালুক্য-রাজ, উড়িষ্যা ও কামরুপের রাজা বাংলা আক্রমণ করেন। সুদীর্ঘকাল ধরে একের পর এক বিদেশি আক্রমণ মোকাবেলা করতে গিয়ে পাল সাম্রাজ্য যখন বিপর্যস্ত, তখন দেশের অভ্যন্তরেও বিরোধ ও অনৈক্য দেখা দেয়। এরই সুযোগে বাংলার বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। বাংলার বাইরে বিহার পাল রাজাদের হাতছাড়া হতে থাকে। এভাবে তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে বাংলার পাল সাম্রাজ্য বহু স্বাধীন খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
এরপর পাল সিংহাসনে বসেন তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল। তাঁর সময় পাল রাজত্বের দুর্যোগ আরও ঘনীভূত হয়। এ সময় উত্তর বঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্তবর্গ প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইতিহাসে এ বিদ্রোহ ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত নায়ক দিব্যোক বা দিব্য। তিনি দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে বরেন্দ্র দখল করে নেন এবং নিজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
বরেন্দ্র অঞ্চল যখন কৈবর্ত্যদের দখলে তখন পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন দ্বিতীয় মহীপালের ছোট ভাই দ্বিতীয় শূরপাল (আ: ১০৮০-১০৮২ খ্রিঃ)। অতঃপর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামপাল (খ্রিঃ ১০৮২-১১২৪ খ্রি) সিংহাসনে বসেন। তিনিই ছিলেন পাল বংশের সর্বশেষ সফল শাসক। প্রাচীন বাংলার কবি সন্ধাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ হতে রামপালের জীবন কথা জানা যায়। রামপাল রাজ্যভার গ্রহণ করেই বরেন্দ্র উদ্ধার করতে সচেষ্ট হন। এ বিষয়ে রামপালকে সৈন্য, অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসেন রাষ্ট্রকূট, মগধ, রাঢ় দেশসহ চৌদ্দটি অঞ্চলের রাজা। যুদ্ধে কৈবর্তরাজ ভীম পরাজিত ও নিহত হন। এরপর তিনি বর্তমান মালদহের কাছাকাছি ‘রামাবতি’ নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তী পাল রাজাদের শাসনামলে রামাবতিই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। পিতৃভূমি বরেন্দ্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি মগধ, উড়িষ্যা ও কামরূপের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
পাল বংশের দুর্ভাগ্য রামপালের পরবর্তী শাসকগণ ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল। ফলে তাঁদের পক্ষে পালবংশের হাল শক্ত হাতে ধরা সম্ভব ছিল না। রামপালের পর কুমারপাল (আঃ ১১২৪-১১২৯খ্রিঃ), তৃতীয় গোপাল (১১২৯-১১৪৩ খ্রিঃ) ও মদনপাল (আঃ ১১৪৩-১১৬১ খ্রিঃ) একে একে পাল সিংহাসনে বসেন। এ সময় যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। অবশেষে দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিজয় সেন পাল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাংলায় সেন বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

No comments:

Post a Comment